সোজা কথা ডেস্ক রিপোর্ট
মানসিক অসুস্থতার কারণে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিমকে স্বজনেরা রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড হাসপাতালে নিয়ে যান। সোমবার সকালে ভর্তি প্রক্রিয়া চলার মধ্যে হাসপাতালের কর্মীরা তাকে টেনেহিঁচড়ে একটি কক্ষে নিয়ে যান। সিসিটিভি ফুটেজে সেখানে তাকে শারীরিক নির্যাতনের দৃশ্যও দেখা যায়। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যান তিনি। পরিবারের অভিযোগ, হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে।
আনিসুল করিম শিপনের বাবা বাদী হয়ে ১৫ জনকে আসামি করে এ মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় ইতোমধ্যে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন-আরিফ মাহমুদ জয়, রেদোয়ান সাব্বির, মাসুদ, জোবায়ের হোসেন, তানভীর হাসান, তানিফ মোল্লা, সজীব চৌধুরী, অসীম চন্দ্র পাল, লিটন আহাম্মদ ও সাইফুল ইসলাম।
মঙ্গলবার তেজগাঁও পুলিশের ডিসি হারুন-অর রশীদ এক ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান।
মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার মহানগর হাকিম শহিদুল ইসলামের আদালতে আসামিদের হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদাবর থানার পরিদর্শক ফারুক মোল্লা।
আদালতে রিমান্ড আবেদন বাতিল চেয়ে আসামিদের জামিনের আবেদন করেন আইনজীবী মিজানুর রহমানসহ কয়েকজন। শুনানি শেষে আদালতের বিচারক প্রত্যেককে সাত দিন করে রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর করেন।
রিমান্ডের আদেশ পাওয়া আসামিরা হলেন- হাসপাতালটির মার্কেটিং ম্যানাজার আরিফ মাহমুদ জয়, কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির, কিচেন সেফ মো. মাসুদ, ফার্মাসিস্ট তানভীর হাসান, ওয়ার্ডবয় তানিফ মোল্লা, জোবায়ের হোসেন, সজীব চৌধুরী, অসীম চন্দ্র পাল, লিটন আহাম্মেদ ও ওয়ার্ডবয় সাইফুল ইসলাম পলাশ।
বেসরকারি হাসপাতালটি থেকে পুলিশের সংগ্রহ করা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটের দিকে আনিসুল করিমকে টানাহেঁচড়া করে একটি কক্ষে ঢোকানো হচ্ছে। তাকে হাসপাতালের ৫ থেকে ৬ জন কর্মচারী মিলে মাটিতে ফেলে চেপে ধরতে দেখা যায়। এরপর আরও দুইজন তার পা চেপে ধরেন। ওই সময় মাথার দিকে থাকা দুইজন হাতের কনুই দিয়ে তাকে আঘাত করতে থাকেন। একটি কাপড়ের টুকরো দিয়ে তার হাত পেছন থেকে বাঁধতেও দেখা যায়।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, হাসপাতালের কর্মীরা আনিসুলকে মারধর করে। পুরো ঘটনার সময়ে হাসপাতালের ব্যবস্থাপক আরিফ মাহমুদকে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। পুরো ভিডিওর চার মিনিটের মাথায় আনিসুলকে উপুড় করলেও তার দেহ নিস্তেজ অবস্থায় ছিল। একজনকে তখন তার মুখে পানি ছিটাতে দেখা গেছে। সাত মিনিট পর সাদা অ্যাপ্রোন পরা একজন নারী ওই কক্ষে প্রবেশ করেন। ১১ মিনিটের মাথায় কক্ষের দরজা লাগিয়ে দিতে দেখা গেছে। এর দুই মিনিট পর তার বুকে পাম্প করেন অ্যাপ্রোন পরা নারী।
গাজীপুর শহরের রানী বিলাসমণি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০০ সালে এসএসসি ও কাজী আজিমউদ্দিন কলেজ থেকে ২০০২ সালে এইচএসসি পাস করেন আনিসুল। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞানের (৩৩ ব্যাচ) ছাত্র ছিলেন। ৩১তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে প্রথম হন আনিসুল। সর্বশেষ তিনি বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগে ছিলেন। এর আগে তিনি পুলিশ সদর দপ্তর ও র্যাবেও দায়িত্ব পালন করেন।
মঙ্গলবার গাজীপুরের ভাওয়াল রাজবাড়ী মাঠে জানাজা শেষে তাকে সিটি করপোরেশন কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবসহ হাজারো মানুষের চোখের জলে বিদায় নেন আনিসুল। জানাজায় অংশ নেন গাজীপুর জেলা পুলিশ ও মেট্রোপলিটন পুলিশের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
আনিসুলের বাবা ফাইজুদ্দীন আহম্মেদ পুলিশ পরিদর্শক ছিলেন। তাদের গ্রামের বাড়ি কাপাসিয়া উপজেলার সনমানিয়া ইউনিয়নের আড়াল গ্রামে। ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফাইজুদ্দীন মহানগরের বরুদা এলাকায় জমি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। বরুদার এই বাড়িতেই আনিসুলের কেটেছে শৈশব-কৈশোর। পারিবারিক সূত্র জানায়, ২০১১ সালে আনিসুল বিয়ে করেন। তার স্ত্রী শারমিন সুলতানাও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের। এ দম্পতির সাফরান করিম নামের ছেলে রয়েছে।
জানাজার আগে উপস্থিত মুসল্লিদের উদ্দেশে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার বড় ভাই বলেন, খুব চাপা স্বভাবের শিপন মানসিক চাপে থাকলেও কাউকে কিছু বলত না। সম্প্রতি তার কিছুটা মানসিক সমস্যা হচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রী ও আইজিপির কাছে তার হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেন তিনি। বাবা ফাইজুদ্দীনও ছেলের এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর বিচার চান।