বয়স ১৬০ বছর হলেও আকর্ষণ এতটুকু কমেনি। বরং বেড়েছে এবং দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। আজও সবার বড্ড প্রিয়, এমনকি এই বয়সেও দেশজুড়েই শুধু নয়, প্রবাসী বাংলাদেশীদেরও মনোরঞ্জন করে যাচ্ছে! বলছি বাংলাদেশের মেহেরপুরের ঐতিহ্যবাহী সাবিত্রী মিষ্টির কথা।
অবিভক্ত ভারতের নদিয়া জেলার পাঁচ মহকুমার মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক নগরী ছিল বর্তমান বাংলাদেশের মেহেরপুর। ১৮৬১ সালে এই মেহেরপুরের বাসুদেব সাহা দুধের ছানা ও চিনি যোগে প্রথম এমন এক মিষ্টি তৈরি করেন যার নাম রাখেন সাবিত্রী। সাবিত্রী নামের কারণ এর নির্ভেজাল উপকরণ। খাঁটি বা নির্ভেজাল অর্থে সতী-সাবিত্রী শব্দ ব্যবহার প্রাচীন কাল থেকেই। এ কারণে এ মিষ্টির নামকরণ করেন সাবিত্রী।
যাইহোক, এই মেহেরপুরের জমিদার সুরেন বোসের বাড়ির সামনে বাসুদেব নির্মিত টালির বাড়ির একাংশে ছিল সাবিত্রীর আঁতুড়ঘর। বাসুদেব, প্রথম জমিদার মশাইকে সেই মিষ্টি পরিবেশন করলে অত্যন্ত প্রীত হয়ে তিনি অতিথিদের সাবিত্রী দিয়েই আপ্যায়ন শুরু করেন। ব্যস, অতুলনীয় স্বাদের গুনে অল্প সময়ের মধ্যেই পুরো নদিয়া জেলায় স্বমহিমায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই মিষ্টি। সেই শুরু।
যদিও আজ সেখানে সেই টালির চাল আর নেই, হয়ে গেছে দোতলা বাড়ি আর তার নীচে ‘বাসুদেব গ্র্যান্ডসন্স’ নামে বাসুদেবের দুই নাতি বিকাশ কুমার সাহা ও অনন্ত কুমার সাহা আজও মানুষের রসনার সেবা করে যাচ্ছেন। সময়ের হিসাবে তা পেরিয়ে গেছে প্রায় ১৬০ বছর।
এই মিষ্টির বিশেষত্ব হল, নির্ভেজাল দুধের ছানা ও চিনি এই মিষ্টির উপকরণ। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খাঁটি দুধ ভাল করে জাল দিয়ে গুটি ছানা করা হয়। পরে কয়েক ধাপে তৈরি হয় সাবিত্রী। সেই ১৬০ বছর আগে সাবিত্রী তৈরির মূল কারিগর ছিলেন বাসুদেব সাহা। শুরুটা তিনি করেন। তার নামেই দোকানের নামকরণ করা হয়েছে। বাবার কাছ থেকে বিদ্যাটি রপ্ত করে ছেলে রবীন্দ্রনাথ সাহা এ মিষ্টি তৈরি করেছেন। তার যুগও শেষ হয়েছে। এখন নাতিরা লালন করছেন সাবিত্রীকে। তিন পুরুষের চর্চা। পরম যত্নে ভালবাসায় একে টিকিয়ে রেখেছে বর্তমান প্রজন্ম। পূর্ব পুরুষের সততা শুদ্ধতা ধরে রাখার আন্তরিক চেষ্টাই সাবিত্রীকে অন্য মিষ্টি থেকে আলাদা করেছে।
মিষ্টি তৈরির কাজ হয় প্রতিদিন সকালে। গ্রাম থেকে সংগ্রহ করা খাঁটি দুধ ব্যবহার করেন তারা। এক কেজি ভাল দুধে ৬ থেকে ৮টা সাবিত্রী তৈরি করা যায়। প্রথমে লাকড়ির আগুনে দুধ ভাল করে জাল দিয়ে গুটিছানা করা হয়। পরে কয়েক ধাপে তৈরি হয় সাবিত্রী। দিনে মাত্র ১৫ থেকে ২০ কেজি মিষ্টি তৈরি সম্ভব হয়। আর প্রতি কেজি সাবিত্রী বিক্রি হয় ৩০০ টাকা করে।
বেলা ৩ টার পর আর কোনো মিষ্টি অবশিষ্ট থাকে না দোকানে। মজার ব্যাপার হল, সাবেত্রী মিষ্টির বাহির থেকে শুকনো মনে হলেও ভিতরে রসে টইটুম্বুর! এগুলো যত পুরনো হয়, তত এর স্বাদ বাড়ে। ফ্রিজে না রেখে অনেক দিন সংরক্ষণ করেও খাওয়া যায়।
এই মিষ্টি তৈরি হয় বংশপরম্পরায়, বাসুদেবের বংশধর ছাড়া বাইরের কাউকে এই কাজে নিয়োগ করা হয় না। এঁরা নিজেরাই মালিক, নিজেরাই কারিগর এবং বিক্রেতা। এমনকি মিষ্টি তৈরির কৌশল কেউ জানতে চাইলে তাঁরা বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। হ্যা, একবার খেলে স্বাদটা জিবে লেগে থাকে। ঢাকায় অনলাইনে বিক্রি করা “মেহেরপুরের ঐতিহ্যবাহী সাবেত্রী মিষ্টি” শতভাগ ভেজাল। অর্থাৎ মেহেরপুরের ‘বাসুদেব গ্রাণ্ড সন্স’ মিষ্টির দোকানের তৈরী নয়।
সময়ের ব্যবধানে এত কিছু বদলেছে, হারিয়ে গেছে, সাবিত্রী আছে আগের মতোই। স্থানীয়দের বিয়েতে, উৎসব অনুষ্ঠানে, অতিথি আপ্যায়নে সাবিত্রী থাকা চাই-ই চাই। এভাবে সারা দেশেই সাবিত্রীর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে।
– হুমায়ুন কবির, অনলাইন এক্টিভিস্ট