মানবতা বিরোধী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবীটিকে ক্ষমতাসীন সরকার উপেক্ষা করে চলেছে। এই আইনটি প্রাথমিকভাবে সাইবার বুলি-উস্কানি-গুজব এরকম নেতিবাচক কাজ প্রতিহত করার অঙ্গীকারে প্রণয়ন করা হলেও; কার্যত তা ব্যবহৃত হয়েছে ভিন্নমত দমন ও নিপীড়নে। সেই নিপীড়নে কারাগারে লেখক মুশতাকের মৃত্যু হয়েছে; কারগারে দীর্ঘদিন আটক থেকে জীবন্মৃত হয়ে ফিরে এসেছেন সাংবাদিক কাজল। কার্টুনিস্ট কিশোর কারাগারের নির্যাতনে অসুস্থ প্রৌঢ় হয়ে ফিরেছেন। জানিয়েছেন, শুধু কার্টুন আঁকার দায়ে তার ওপর চলা নির্যাতনের কথা। কিশোর এখন চিকিৎসাধীন। এরকম অসংখ্য নাম আছে; উল্লেখ-অনুল্লেখে কিছু এসে যায় না। কিন্তু সরকার তার এই কালো আইনটি কোনভাবেই বাতিল করতে রাজি নয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএসএ জারি রাখার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কারাগারে লেখক মুশতাকের মৃত্যুর ব্যাপারে বলেছেন, অসুস্থ হয়ে মারা গেলে কী করার আছে। উল্লেখ্য যে শেখ হাসিনার পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তার জীবনের একটা দীর্ঘ সময় পাকিস্তান সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদ জানিয়ে কারাগারে থেকেছেন। একজন মানুষকে সরকারের কাজের সমালোচনার জন্য গ্রেফতার করে কারাগারে রাখলে তার স্ত্রী-সন্তানেরা কীরকম কষ্টে থাকে এটা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর সরকার বিরোধী প্রতিবাদকে পাকিস্তানশাহী রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের তকমা দিতো। কিন্তু সরকার বিরোধিতা যে রাষ্ট্র বিরোধিতা নয়; এটা বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত একটি ধ্রুব সত্য।
লেখক মুশতাকের মৃত্যুর পর সরকার সমর্থকদের একাংশ মুশতাকের মৃত্যুতেই খুশি না থেকে; এর শব ব্যবচ্ছেদ করেছে। মুশতাক যে পেইজ চালাতো সেটিকে রাষ্ট্রবিরোধীর তকমা দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজম কারাগারে ভি আইপি মর্যাদা পেয়ে বার্ধক্যজনিত স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেছেন। যুদ্ধাপরাধী সাঈদী ভি আইপি মর্যাদায় কারাগারে আছেন; তার নিয়মিত মেডিকেল চেক আপ হয়। কিন্তু মুশতাক যেন তার চেয়ে বড় অপরাধী; এমন বড় ষড়যন্ত্র করেছেন যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে গন্ধমাদন পর্বতের মতো তুলে নিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন; এমন একটি অভিমত প্রতিফলিত সরকারের সমর্থকদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের লেখাজোঁকায়।
একাত্তরের যুদ্ধ চলাকালে সংগ্রাম পত্রিকায় পাকিস্তানশাহীর সমর্থকেরা যেভাবে পাতায় পাতায়, তাদের দৃষ্টিতে ‘ষড়যন্ত্রী’দের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতো; ফেসবুকের পাতায় পাতায় এই স্বাধীন দেশে বাংলাদেশশাহীর অন্যায়ের প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে চলেছে সরকার সমর্থকদের অনেকে। একই দৃষ্টিভঙ্গি শোষিতের বিরুদ্ধে শোষকের; যে ক্রোধ-দম্ভ-তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য-নিষ্ঠুরতা সবই উপস্থিত যেন দেজাভুর মতো।
ইতিহাসে কোন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে; সেই রেফারেন্স নিয়ে আলোচনা স্বতঃসিদ্ধ একটি বিষয়। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে “মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পবিত্র অনুভূতি” আওয়ামী লীগের নিজস্ব বা একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহৃত। এই দেশের স্বাধীনতার কৃতিত্ব-সুফল-এর পবিত্রতা রক্ষা সবই আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র ব্যাপার। সুতরাং এসময়ের ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ সরকার সেই পাকিস্তান বা বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলের মতো নিবর্তনমূলক আইন দিয়ে নিগ্রহ করছেন; এ কথা বললে; সরকার সমর্থকদের মুক্তিযুদ্ধের অনুভূতি আহত হয়। ঠিক যেমন ধর্ম-ব্যবসার নিবর্তনমূলক কর্মকান্ডের সমালোচনা করলে ধর্মের ম্যানেজারদের ইসলাম ধর্মের অনুভূতি আহত হয়।
আওয়ামী লীগের এই স্বপ্রণোদিত মুক্তিযুদ্ধের ম্যানেজারেরা এইভাবে; যেই সরকারের সমালোচনা করুক; তাকেই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি বলে তকমা দেয়। ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুনের প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই; যিনি বাংলাদেশকে স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ এই দুইভাগে ভাগ করে; মোজেসের মতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গোল্ডেন কাফটিকে আওয়ামী লীগের পূজার ঘরে সংস্থাপন করেছেন। এরপর ফিরে গেছেন ফার্মার্স ব্যাংকের কৃষক সেবার দায়িত্বে!
এতে সুবিধা হয়েছে এই যে, আওয়ামী লীগ যেভাবে খুশি দেশ চালাবে; কিন্তু এর জনবিরোধী কোন কাজের সমালোচনা করলেই; সরকার সমর্থকেরা রায় ঘোষণা করে, অভিমত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে যারা কাজ করে; তারা স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি। দেশটাকে মুখোশ পরে গন্ধমাদন পর্বতের মতো তুলে নিয়ে যাবে তারা। শুধু আওয়ামী লীগ সমর্থকই নন, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের অনেক সদস্য প্রকাশ্যে সরকারের কোন সিদ্ধান্তে ভিন্নমত পোষণকারীদের “স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি হিসেবে” চিহ্নিত করে “পাকিস্তানে চলে যাবার হুকুম দিয়েছেন।” দেশটা যেন তাদের বাবার সম্পত্তি; যখন খুশি যাকে অপছন্দ হবে; তাকেই শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে দেশ থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া যাবে।
অভিমত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার প্রয়োজনে এই নিবর্তনমূলক-প্রাণঘাতী মানবতা বিরোধী ডিজিটাল সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি যারাই জানাচ্ছে; তাদেরকেই শত্রু বলে চিহ্নিত করছে সরকার সমর্থক কিছু আওয়ামী লীগ কর্মী; তারা ফেসবুকে সরকার সমালোচনার স্ক্রিন শট নিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে সাইবার সুপার কপদের কাছে;’ যারা ফেসবুকে দেশের মালিক সেলিব্রেটির মর্যাদায় অভিষিক্ত। এই স্ক্রিনশট নেয়া; সরকার সমালোচকের তালিকা করা; তাদের রাষ্ট্রের শত্রু বলে চিহিত করার প্যাটার্নটিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাতসি কর্মকাণ্ড বা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার কর্মকান্ডের সঙ্গে প্রতিতুলনা করলে; আরেক দফা আহত হয় আওয়ামী লীগের স্বপ্রণোদিত সাইবার পিকেটারদের “মুক্তিযুদ্ধ অনুভূতি”। যেহেতু দেশপ্রেম-মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত ইতিহাসের গোল্ডেন কাফ আওয়ামী লীগের পূজার ঘরে; এর ওপর আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র অধিকার; কাজেই সাইবার পিকেটারেরা “অভিমতের স্বাধীনতার জন্য সক্রিয়’দের মুখোশ উন্মোচন করার পবিত্র দায়িত্বে নিয়োজিত হয়। “যেই বাক-স্বাধীনতা চাইবে; সেই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি”-এরকম সোনালী সূত্র আবিষ্কৃত হয়।
১৯৪৭ সালের স্বদেশযোদ্ধা ক্ষমতা-কাঠামোর পরিপার্শ্বে থেকে ঠিক
এই “নরভোজের নৈশভোজই” যেন আমার মাতৃভূমি
এমনটাই হয়েছিলো তাদের। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষমতা কাঠামোর রাজাকার হয়ে; যেই দেশের মুক্তি চাইবে; সেই পাকিস্তানের স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি; এই সোনালী সূত্রের টুপি মাথায় পরেছিলো তারা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধা ক্ষমতা-কাঠামোর পরিপার্শ্বে থেকে এখন ঠিক সেই একই দম্ভের পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছেন যেন। আর দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় এর সমর্থকের সংখ্যা এখন গাছের পাতার সংখ্যার চেয়েও বেশি। ক্ষমতা যে ক্যাশ কাউ; সে নিয়মিত টেকাটুকার দুধ দেয়। তাই এই ক্যাশকাউকে চিরস্থায়ীভাবে আওয়ামী লীগের পূজার ঘরে সংস্থাপিত রাখতে হবে। সে কারণে এখন আওয়ামী লীগের সমালোচনা করা মানেই লোকটি “স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি” ও “রাষ্ট্রদ্রোহী”। আওয়ামী লীগ যেন রাষ্ট্র; এর সমর্থকেরা সেই রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। আর সরকার সমালোচনা মানেই যেহেতু রাষ্ট্রের সমালোচক মানেই রাষ্ট্রদ্রোহী; তাকে দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে ধমক দেয়া যায়; তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা যায়; সেখানে মৃত্যু হলে বলে দেয়া যায়, আল্লার মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে।
এইভাবে ক্ষমতার লাস্যে; ক্ষমতার ক্যাশকাউয়ের দুগ্ধ বলীবর্দ শরীর বানিয়ে বাহুবলি দেশপ্রেমের ম্যানেজারেরা এখন তাদের দেহভঙ্গিতে সর্বময় দেশের মালিক।
কাউকে এলিট ফোর্স দিয়ে তুলে নিয়ে; চোখ বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে নির্যাতন করে বলাতে হয়, হীরকের রাজা ভগবান। আর নির্যাতনে মারা গেলে; “অসুস্থ হইয়া মারা গেলে পুলিশ কী করবে” এরকম গাছাড়া দায়িত্ব অস্বীকার করা শীর্ষ বাঁশি শুনে সমর্থকদের একাংশ ফেসবুকে নরভোজি হয়ে ওঠে; যেন শকুনেরা কারাগারে তিলে তিলে মরে যাওয়া মুশতাকের চোখ খুবলে খায়; কান চিবিয়ে খায়; হাউ মাউ খাউ মানুষের গন্ধ পাঁও বলে ছুটে আসে স্বপ্রণোদিত দেশপ্রেমের নরভোজী ম্যানেজারেরা। এই “নরভোজের নৈশভোজই” যেন আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া