একজন বুদ্ধিজীবী একটি দলীয় আদর্শ সমর্থন করতে পারেন। পৃথিবীর সব দেশেই বুদ্ধিজীবীদের মাঝে এরকম চর্চা আছে। আবার অনেকে আছে দল নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী। জাফর ইকবালের আওয়ামী লীগ সমর্থন, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিএনপি সমর্থন, বদরুদ্দীন উমরের বামদল সমর্থন; তাদের ইচ্ছার স্বাধীনতা; আবার সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের দল নিরপেক্ষতা খুব উজ্জ্বল বাস্তবতা। এইসব সমর্থন কিংবা নিরপেক্ষতার গোড়ার কথা হচ্ছে দেশ ও সমাজকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে তারা একই বিন্দুতে। সলিমুল্লাহ খান তার ইতিহাস অনুসন্ধানে একটি ন্যারেটিভকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন; ফরহাদ মজহার সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করতে পারেন, তার মতো করে। শাহরিয়ার কবির সৃষ্টিকর্তাকে আরেকভাবে খুঁজতে পারেন। বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে সবাই হয় শেখ হাসিনার স্তুতি করবেন, কিংবা খালেদা জিয়ার স্তুতি করবেন; এরকম একপেশে চাওয়া যাদের; পৃথিবীর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ইতিহাস সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না।
আমাদের বাংলাদেশকালে টেকাটুকার সোনার হরিণের পিছে দৌড়ে; শিক্ষাব্যবস্থাকে অবহেলা করে; আমরা দলীয় টেকাটুকার মেশিন দখলের জন্য একপেশে চিন্তার হুল্লোড় দেখতে পাই। টিএসসির সামনে জাতীয় কবিতা পরিষদের আসরে “কিংবদন্তীর কথা বলছি”-র কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহকে দাওয়াত দিয়ে এনে অপমান করায় তার স্ট্রোকে মৃত্যুর খবরটি যেদিন শুনলাম; সেদিনই বুঝেছিলাম বাংলাদেশ অন্ধকারের দিকে যাত্রা করছে। আবু জাফর এরশাদ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন বলে তাকে এনে যারা মানসিক পীড়নে হত্যা করেছিলো; তারা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিকর্মীরা। তাদের একজন কোমর শুকিয়ে থাকা এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে এখন ভিসি হবার জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে দেখি। আবার হাসিনা যেদিন এরশাদকে বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ দিলেন, সেদিন মনে হলো, ওহে আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি মামারা, তোমরা কেন কবি আবু জাফরকে হত্যা করলে!
যেদিন জামায়াতের খুনেরা কবি শামসুর রেহমানের শ্যামলীর বাসায় হামলা করেছিলো, যেদিন হুমায়ূন আজাদকে চাপাতি দিয়ে কোপালো তারা; সেদিন আমি বুঝে গিয়েছিলাম, এইদেশ পাকিস্তানের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। এখানে প্রগতিশীলতার চর্চা অসম্ভব হয়ে উঠবে। নজরুলের মাজারের পাশে বিএনপির ছাত্র সংগঠন যেদিন রামেন্দু মজুমদারকে হামলা করেছিলো, বুঝেছিলাম এই দেশ বুদ্ধিজীবীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এরপর এলো ইন্টারযুগ। তখন কাউকে মানসিকভাবে হত্যা করতে আর ভূমিবাস্তবতার অপমান প্রয়োজন নেই। ফেসবুকে ইউনিভার্সিটি ড্রপ আউট শিয়াল অনায়াসে যে কোন বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে বাংলা চটির ভাষায় আকথা-কুকথা বললে; অন্য শেয়ালেরা হুক্কা-হুয়া দিয়ে ওঠে। তরুণদের প্রাণের শাহবাগ আন্দোলনে বিরিয়ানি বহর নিয়ে ঢুকে বাকস্বাধীনতাহরণের শেয়ালেরা আওয়ামী লীগের সমালোচক বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে নোংরা কথার পসরা সাজালো। এর বিপরীতে বাঁশের কেল্লার শেয়ালেরা আওয়ামী লীগ ও বামচিন্তার সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের “কল্লা নামিয়ে দেবা”-র প্রকাশ্য ঘোষণা নিয়ে হাজির হলো। বাংলাদেশ ছেয়ে গেলো “আম্মি ও বিম্পি” ফইন্নির ঘরের ফইন্নির অপসংস্কৃতিতে।
বদরুদ্দীন উমরের জুতাটিও যার চেয়ে শিক্ষিত, সেই অর্ধশিক্ষিত লোকটিও এসে দাঁত কেলিয়ে বদরুদ্দীন উমরকে গালি দিয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধে পিতা হারানো জাফর ইকবাল যুদ্ধের সময় “চকির তলায় লুকিয়ে ছিলেন”, মুক্তিযুদ্ধে দুই বড় ভাই হারানো শাহরিয়ার কবির “পাক-সেনাদের মুরগী সাপ্লাই করতেন”-ইত্যাদি নির্বোধ রগড় করতে থাকে দুই পয়সার বিম্পি সমর্থকেরা। ফরহাদ মজহারকে গোয়েন্দা সংস্থার একই স্ট্যান্ডার্ডের ফইন্নি দিয়ে গুম করিয়ে দুই পয়সার আম্মি সমর্থকেরা ফাঁদলো তাদের অশ্লীল চটি গল্প। আসিফ নজরুলের ছবিতে “মদের বোতল” লালচিহ্নে দেখিয়ে অসাম্প্রদায়িকতার চেতনার ল্যাঙ্গট পরা শেয়ালেরা হাহাহিহি করতে থাকলো। আবার দুই পয়সার শিবসেনা এসে সলিমুল্লাহ’র জ্ঞানের মাপামাপি শুরু করলো ফেসবুকে। এই অশ্লীল কুরুক্ষেত্র রচিত হয়েছে শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়া আর জামায়াত বিষবৃক্ষের ছায়ায়।
এদের বাপেরা সুচিন্তা ও হাওয়া ভবন সাজিয়ে দেশের লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করলো; বেগমপাড়ায় আলকাপনৃত্যে চোরের খনির মুজরা সাজালো; তাদের নিয়ে টুঁ শব্দটি করার ক্ষমতা নেই এইসব হুক্কাহুয়া শেয়ালদের। বুদ্ধিজীবীদের অপমান করার ক্ষেত্রে “সব শেয়ালের একই রাঁ”।
এইসব ফইন্নির ঘরের ফইন্নি জানে, দেশে দলীয় ঠিকাদারি করে খড়ের ঘরের জায়গায় প্রাসাদ তুলতে পারবে; চুলে জেল দিয়ে ওয়েস্টইন-এ সেলফি তুলতে পারবে; কিন্তু ঐ যে জ্ঞানবৃক্ষ ঐ যে সংস্কৃতি ও সভ্যতার আলো; তা অর্জন তাদের বাপেরও সাধ্য নেই।
বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ২০০১ থেকে আজ পর্যন্ত চলমান অপশাসনে শিক্ষা–সংস্কৃতি-প্রগতি এসব নির্মূল করে; স্থূল শাসক শোষক পরিতোষক, ভণ্ড সংস্কৃতিধারক-এর বুলবুলি আখড়াই বসানো হয়েছে। প্রতিটি দিন-প্রতিটি মুহূর্তে তাদের শত্রুতা শিক্ষা ও প্রজ্ঞার সঙ্গে। বুদ্ধিজীবীরা হচ্ছে শিক্ষা ও প্রজ্ঞার প্রতীক। সেইসব প্রতীক সেইসব আইকন ভেঙ্গে সেখানে খর্ব চিন্তার বামনের প্রতিমূর্তি বসাতে মরিয়া এইসব দলীয় সাইবার সৈনিক। বাংলাদেশকে বাঁচাতে এইসব সাইবদরকে প্রতিহত করতে হবে।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক