এইচএসসি পাস করার পর আমি সেনাবাহিনীতে যাবার জন্য আই এস এস বি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেয়ে যাই। সেসময় জিয়া-এরশাদ ছিলেন সাফল্যের প্রতীক। ফলে উচ্চ শিক্ষা অর্থহীন মনে হচ্ছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘ ইউনিটে চান্স পেলেও ভাইভা দিতে না গিয়ে সি এম এইচ-এ গিয়েছিলাম মেডিকেল টেস্টে। আম্মা আমার সার্টিফিকেট-মার্কশিট নিয়ে ভাইভা দিতে গিয়ে ঘ ইউনিটের ভাইভা বোর্ডকে বলেন, আমার ছেলে বিভ্রান্ত হয়ে আর্মিতে চলে যাচ্ছে; আমি চাই সে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হোক। অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ওকে ইংরেজিতে নিয়ে নিচ্ছি; আপনি আপনার ছেলেকে ও পথ থেকে ফেরান।
এই যে ঐ বয়সে নিজেকে সবচেয়ে বুদ্ধিমান মনে হওয়া; আব্বা-আম্মাকে ‘উনারা আবার কী বোঝেন, এটা মনে হওয়া”; কিছুদিন আগে সেটা ঘটেছিলো আমার ছেলের ক্ষেত্রে। সে পশ্চিমের একটা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়তো। ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজিকে গোল্ড মেডেল পায়; ওর স্কুলের রোল অফ অনারে ওর নাম শীর্ষে দেখলাম। স্কুলের টুইটার একাউন্টে দেখলাম, ওকে উদ্ধৃত করে স্কুল অথোরিটি লিখেছে, আমাদের এই ছাত্রটি প্রতিদিন স্কুলে এসে প্রথমেই ক্লিনিং স্টাফের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে; তারপর স্কুল করিডোরে কারো মন খারাপ দেখলে তার সঙ্গে একটু কথা বলে। ছাত্রটির দর্শন হচ্ছে, খুব সকালে আপনার একটু হেসে কথা বলা, আরেকজন মানুষের দিনটাকে সুন্দর করে তুলতে পারে। সেই টুইটার পোস্টে কমেন্টস সেকশানে দেখলাম ওর নারী বন্ধুদের সোচ্ছ্বাস উপস্থিতি। কী সুন্দর সব কমেন্ট। এ প্রজন্মের বাচ্চাদের মনটা কত সুন্দর তা ধরা পড়ে শব্দ চয়নে।
টুয়েলভ ক্লাস পার হলে সে তার দাদাকে বলে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়তে চাই। আব্বা বলেছেন, যাতে আনন্দ পাও ঠিক তাই পড়ো। মিউজিক, ম্যাথেম্যাটিকস, পলিটিক্যাল সায়েন্স; এসব কম্বিনেশন নিয়ে আন্ডার গ্র্যাজুয়েশনে পড়ছিলো। দাদা মারা যাবার পর সিদ্ধান্ত নেয়, কিছুদিন ব্রেক নেয়া যাক। স্কুলে সোশ্যাল ওয়ার্ক করা ছেলে-মেয়েদের চাকরির অফার তো থাকেই। ওরা কয়েকজন বন্ধু ভাবছে, বিল গেটস-মার্ক জুকারবার্গ তো বড় ডিগ্রি নেয়নি; আমরা কেন এই ঝামেলা করবো!
আবার তার দাদী যেন ফিরে যান ৩০ বছর আগের বাস্তবতায়; যখন তার ছেলে ভেবেছিলো; কী হয় ইউনিভার্সিটি পড়ে। আর্মিতে গিয়ে জিয়া-এরশাদ হবো। আম্মা তার নাতিকে বুঝাতে শুরু করেন, গ্র্যাজুয়েশন করো; তারপর যা খুশি করো। সে করোনাকালের ক্যাম্পাস জীবন মিস করে জুম ক্লাস করতে করতে বোরড হয়ে চাইছিলো কাজের ছুঁতোতে বাইরে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু দাদী এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দেন। উলটো মিউজিক-ম্যাথেমেটিকস-এর জন্য প্রাইভেট টিউটর ধরিয়ে দেয়া হয় তাকে।
আমি হঠাত একটু উষ্মা প্রকাশ করলাম; রাগ দেখাবো না;মেটামরফসিসের গ্রেগর সামসার বাবার মতো কোনদিন ছেলেকে বকা দেবো না; এই শপথ ভেঙ্গে। মিদ্রাহ শুরু করলো বিতর্ক। সে বললো, চাচ্চুর সঙ্গে সপ্তাহে একদিন আড্ডা দিই। তাকে জিজ্ঞেস করে দেখো বাবা, কারেন্ট এফেয়ার্স, ফিলসফি, হিউম্যান রাইটস, এনভায়নমেন্ট, জেন্ডার এসব বিষয়ে যথেষ্ট জানি কীনা। আমার চেয়ে অনেক বেশি কনভিন্সিং টোনে কথা বলে সে। বাংলা শব্দ চয়নে সে একেবারেই ওর দাদার মতো করে কথা বলে। দাদা শিক্ষক ছিলেন বলে, তার সঙ্গে থেকে থেকে ওর ধারণা হয়েছে, সে শিক্ষকতা করতে সক্ষম। বিতর্কে পারা কঠিন ওর সঙ্গে। কিছুক্ষণ ইংরেজিতে ডিবেট করে; সে বাংলায় ওর জানা-শোনার পরিধি ব্যাখ্যা করে শেষ বাক্য বললো, বাবা আমি ভালো করছি তো। তুমি মাকে কেন বলেছো যে, আমি ভালো করছি না!
আমি বুঝালাম, রবীন্দ্রনাথ স্কুলে পড়েননি বলে; অনেকেই শিক্ষাজীবন শেষ করেনি সেকালে; তারা তো রবীন্দ্রনাথ হতে পারেনি। পড়ালেখা শেষ করো, তারপর ডিজে হও, সেলসম্যান হও; যা করে আনন্দ পাও তা করো। তবে পাশাপাশি কোথাও মিউজিক টিচার হলে খুশি হবো। আব্বা আমাকে যে ডায়ালগ তিরিশ বছর আগে দিয়েছিলেন, আমি সেটাই কপি পেস্ট করে বললাম।
ওর মা আমাকে শান্ত করে বললো, নিশ্চিত থাকো; ওকে পড়ালেখা করতে হবে। আর ওর দিদা-চাচ্চু তো নিয়মিত তো অনুপ্রেরণা দেয়; ফলে কতই বা বিগড়াবে সে!আমি বললাম, আমার সব ছাত্র-ছাত্রীই আমার সন্তানের মতো। কাজেই আমার স্বপ্নপূরণ আমার ছেলেকেই করতে হবে; এমন কথা নেই। ওর মা বললো, তোমার সঙ্গে বিতর্ক করা অর্থহীন। সমস্যা হচ্ছে তোমার ছেলেও মনে করে ওর সঙ্গেও বিতর্কে কেউ জিততে পারবে না। তোমাদের জীবনটাই বিতর্কের আনন্দের। আমরা তো বিতার্কিক নই। কভিডের কারণে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হয়েছে; এতে তোমার ছেলে একটু রেস্টলেস। ঠিক হয়ে যাবে।
এরকম সমস্যা শুধু আমার ছেলেই করছে তা নয়; আমার ছাত্ররাও অনেকে জিজ্ঞেস করে, ইউনিভার্সিটিতে কেন পড়ছি স্যার। এখানে কী শেখার কিছু আছে। আমার একজন নারী কলিগ একদিন ক্লাস রুম থেকে কাঁদতে কাঁদতে ফিরেছিলো ওদের এসব যুক্তিতর্কে।ইন্টারনেট প্রযুক্তির কারণে জগত জোড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এই নতুন প্রজন্ম। ফলে ওদের মাঝে ‘সবজান্তা’ ভাব এসেছে। কিন্তু না পড়লে জ্ঞান আসবে কোত্থেকে। কতগুলো ট্রেন্ডি বাযওয়ার্ড বলে; কথার খই ফুটালেই তো আর জ্ঞানী হওয়া যায় না।ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের ভাবসাব দেখে মনে হয়, সবাই হোয়াইট হাউজ চালাচ্ছে, খুব ব্যস্ত। কী নিয়ে তা জানিনা। খুঁজে পেতে স্টাডি মেটেরিয়ালের লিংক দিলেও তা পড়ার সময় নেই; বই তো দূরে থাক। আমি জানিনা, এরা কতোটা সাবস্টানশিয়াল কাজ করতে পারবে! দেয়ার ইজ নো শর্টকাট টু সাকসেস।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক, ই – সাউথ এশিয়া