কিছুদিন আগে আমি টেকনাফে গিয়েছিলাম, র্যাপলিং করার উদ্দেশ্যে। সেখানে একটি ছেলের সাথে পরিচয় হলো। খুব ভালো একটি ছেলে। এখন সে বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। কিছুদিন আগেও তার বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন বোনটি বেঁচে ছিলো। এখন মৃত। এখন একমাত্র সন্তান হবার কারণে বাবা মা তাকে খুব বেশি আঁকড়ে ধরে রাখতে চান। তাই এই পাহাড়ে র্যাপলিং করতে আসার কথাটা সে বাবা মাকে জানায় নি। এমন কি র্যাপলিং এর এত দারুণ ভিডিও করা হলো, সেগুলোও বাবা মায়ের কাছে শেয়ার করবে না। তাহলে আর কোনদিন তাকে বাসার বাইরে যেতে দেবে না, তার বাবা মা। আমিও কতক্ষণ ভাবলাম, বাবা মায়ের কাছে কি মিথ্যে বলা ঠিক কিনা? টিএনেজারদের উদ্দেশ্যে আমি নিজেই তো বলি, যে কাজের কথা তুমি তোমার বাবা মায়ের কাছে শেয়ার করতে পারবে না, সে কাজ কখনো তুমি করবে না। কিন্তু আজ এই ছেলেটির সমস্যার সামনে দাঁড়িয়ে আমি নিজেই বললাম, এই ছবি/ভিডিওগুলো তোমার বাবা মাকে দেখিও না, তাহলে তাঁরা অহেতুক ভয় পাবেন আর তোমাকে নিয়ে টেনশন করবেন।
বাবা মায়েরা সন্তানকে নিয়ে টেনশন করেন। দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও অপরাধের ভয়ংকর ঘটনাগুলো সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা যার রয়েছে, তিনিই তার পরিবারের সবার জন্য দুশ্চিন্তা করবেন। ফলে সন্তানের গণ্ডিতে বাবা মায়েরা রাশ টেনে ধরেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি, আমি ছিলা্ম এক বন্দী শিশু। শৈশবে সামান্য অসাবধানতার কারণে দূর্ঘটনায় শারীরিকভাবে আঘাত পেয়েছিলাম। সেই থেকে বাবা মা আমাকে নিয়ে অতিরিক্ত সতর্ক ও দুশ্চিন্তা করাতে কোথাও যেতে দিতেন না, এমন কি বিকেলে বন্ধুদের সাথে খেলতে যাওয়াও মানা ছিলো। সারাক্ষণ ঘরে , অভিভাবকের নজরবন্দী হয়ে থাকতে হতো। ফলে আমার শৈশবে খারাপ কোন ঘটনা তো ঘটেনি, ভালো কিছুও ঘটে নি। বাইরে কোথাও যাবার অনুমতি না থাকলেও ঘরেও আনন্দের কোন উপস্থিতি ছিলো না। আমি বেড়ে উঠতে থাকলাম একটি বিষন্ন শিশু হিসেবে। সামাজিক দক্ষতা তৈরি হলো না আমার মধ্যে। আমি সব সময় চাইতাম, দ্রুত বড় হয়ে যেতে, তাহলে আমার মুক্তি ঘটবে। বাবা মায়ের হাত থেকেই আমি মুক্তি কামনা করতাম। এমন কি শৈশব কৈশোর পার হয়ে, তারুণ্যেও আমার বন্দীদশার কোন পরিবর্তন ঘটে নি। মেয়ে হয়েছি বলেই ঘটে নি। প্রত্যেকেই নিজের শৈশবকে ফিরে পেতে চায়। আমি কখনোই শৈশবে ফিরতে চাই না। আমি আমার শৈশবকে দীর্ঘায়িত করে নিয়েছি, বরং এখনই আমার প্রকৃত শৈশবকাল পার করছি। সুতরাং অমন বোরিং শৈশব কেন ফেরত চাইবো?
কিন্তু সবার শৈশব কৈশোর আমার মতো নয়। তারুণ্যে পৃথিবী আরো বড় হয়ে ধরা দেয় সবার সামনে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করেই বাবা মায়েরা একটা গণ্ডি টেনে ধরেন, সেই যেমন সীতাকে বলা হয়েছিলো, এই গণ্ডি পার হলেই বিপদ! স্মার্ট বাবা মায়েরা সন্তানের বন্ধু হয়ে বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন করে দিতে চান। স্মার্ট সন্তানেরাও বাবা মায়ের বন্ধু হয়ে ওঠে। তবু যতই বন্ধু হোক, একটা জেনারেশন গ্যাপ থাকেই। সমবয়সী বন্ধুদের সাথে যেভাবে মনের সব কথা শেয়ার করা যায়, বাবা মায়ের সাথে সেভাবে নয়। দূর্গম পাহাড়ের এডভ্যাঞ্চারে যাবার স্বপ্ন বন্ধুদের সাথেই দেখা যায়, বন্ধুরা সেখানে ভরসা দেয়, সাহস যোগায়। আর বাবা মা দেখায় ভয়। কিংবা যদি কাউকে ভালো লেগে যায়, মন চায় ভালোবাসতে! মনের কথাটি ক্রাশকে কিভাবে বলা যায়, বন্ধুরা নানা ভাবে তখন সাহায্য করে। আর বাবা মা ভয় পান, ভয় দেখান। স্মার্ট বাবা মা হলে সন্তানেরা হয়তো কিছুটা শেয়ার করতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঐ বন্ধুরাই ভরসা। এসব ক্ষেত্রে সন্তান তো চাইবেই বাবা মায়ের কাছে নিজেকে একটু আড়াল করতে! । বাবা মা যেমন চায়, ভালো রেজাল্ট, লক্ষ্ণি হয়ে চলা, সবার সামনে সন্তানকে নিয়ে গর্ব করতে, তেমনভাবেই সে ঠিক ঠিক চলে। কিন্তু নিজের ইচ্ছে, নিজের স্বপ্নটাকেও সে জিইয়ে রাখে। বাবা মাকে সে কষ্ট দিতে চায় না, অহেতুক টেনশনে ফেলতে চায় না। তাই একটু মিথ্যে বলে বন্ধুদের সাথে চলে যায় ঘুরতে, কিংবা একদিন ক্লাস একটা না হয় বাং মেরেই বান্ধবীর সাথে রিক্সায় ঘুরলো! তাতে তো কারো ক্ষতি হচ্ছে না! এগুলোকে বলে হোয়াইট লাই। যেমনটা আমার সাথে পাহাড়ে র্যাপলিং করতে গিয়ে ছেলেটি বলেছে তার বাবা মাকে কিংবা ফারদিন বলেছিলো তারা বাবা মাকে, হলে যাবে পড়তে! কিন্তু ফারদিনের বেলায় সব হিসেব নিকেশ যখন উলটে যায়, তখন ঐ সামান্য ‘’হোয়াইট লাই’’য়ের গায়ে কালো কালো ছোপ পড়ে যায়!
সন্তানকে সারাক্ষণ ঘরে আটকে নজরবন্দী রাখাটাও কি কোন সমাধান? আপনার সন্তান তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাবার পথেও বিপদে পড়তে পারে, খুন হতে পারে। এরকম তো অহরহই হচ্ছে, পরীক্ষার্থীকে পথিমধ্যে খুন করে গেছে কোন পূর্ব শত্রুতার জেরে কিংবা কোন শত্রুতা ছাড়াই। হয়তো কোন ছিনতানকারী তাকে ছুরি মেরেছে কিংবা সাবেকুন নাহার বা সামিয়া আফরিন প্রীতির মতো পড়ে গেছে কোন গোলাগুলির ভেতরে! কিংবা কোন বাস এসে চাপা দিয়ে গেছে! সেক্ষেত্রে আপনার সন্তানকে কি তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস করতে বা পরীক্ষা দিতেও যেতে দেবেন না?
শহীদ রুমীর কথা মনে পড়ে? সে কিন্তু মায়ের অনুমতি না নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যায় নি। মা জাহানারা ইমাম প্রথমে চান নি তাঁর সন্তান যুদ্ধে যাক। কিন্তু ছেলে মাকে বুঝিয়েই ছেড়েছে। বুঝদার মাও সন্তানকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দিয়েছিলেন।
আসুন, ঘুম থেকে জাগি। নিজেদের বন্দীদশা থেকে নিজেদেরকেই মুক্ত করতে হবে! আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
– তানিয়া কামরুন নাহার, লেখক ও শিক্ষক