নিজস্ব প্রতিবেদক
পুলিশের নির্যাতনে নিহত রায়হান আহমদের মায়ের আমরণ অনশন ভাঙালেন সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। ছেলে হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবিতে রবিবার (২৫ অক্টোবর) সকালে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির সামনে আমরণ অনশনে বসেন পুলিশি নির্যাতনে নিহত রায়হান আহমদের মা সালমা বেগমসহ তার পরিবারের সদস্যরা।
আজ বিকেল ৫টার দিকে হঠাৎ এই অনশন রূপ নেয় তীব্র আন্দোলনে। রায়হানের পরিবারের সদস্যরা এবং আখালিয়া এলাকার বাসিন্দারা বন্দরবাজারের রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে শুরু করেন। খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
এ সময় তিনি রায়হানের মাকে সান্ত্বনা দিয়ে জুস পান করিয়ে অনশন ভাঙান। পরে বিক্ষোভকারীদের শান্ত করে অবরোধ তুলে দেন।
মেয়র আরিফ রায়হানের মা সালমা বেগমকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, রায়হান হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার ও সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলবো। তারপরও অভিযুক্তরা গ্রেফতার না হলে সিলেটবাসীকে সাথে নিয়ে আমরা বৃহত্তর আন্দোলনে নামবো।
মেয়র বলেন, পুলিশের নির্যাতনে রায়হান হত্যার ঘটনায় সাধারণ মানুষের বিবেকে নাড়া দিয়েছে। মানুষ মনের কষ্ট থেকে আন্দোলনে নেমেছেন। নগরবাসীর এই আন্দোলন সংগ্রামকে আমি সম্মান জানাই।
মেয়রের আশ্বাসে অনশন ভাঙার পর রায়হানের মা সালমা বেগম বলেন, আমি আর আশ্বাস শুনতে চাই না। এখন উদ্যোগ দেখতে চাই। অভিযুক্তদের সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে এ কথা শুনতে চাই।
প্রসঙ্গত গত ১১ অক্টোবর সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে নগরীর নেহারিপাড়া মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে রায়হান আহমদকে গুরুতর আহত অবস্থায় ওসমানী মেডেকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন বন্দরবাজার ফাঁড়ির এএসআই আশেকে এলাহী। সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে হাসপাতালে মারা যান রায়হান। এ ঘটনায় রায়হানের স্ত্রী হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে থানায় মামলা দায়ের করেন। এরপর বন্দর বাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবরসহ চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিন জনকে প্রত্যাহার করা হয়।
মামলার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই ইতোমধ্যে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাশ ও হারুনুর রশিদকে গ্রেফতার করে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ১১ অক্টোবর (রোববার) ভোরে রায়হান আহমদ (৩৩) নামে সিলেট নগরের আখালিয়ার এক যুবক নিহত হন। পুলিশের পক্ষ থেকে প্রথমে প্রচার করা হয়, ছিনতাইয়ের দায়ে নগরের কাষ্টঘর এলাকায় গণপিটুনিতে নিহত হন রায়হান। তবে বিকেলে পরিবারের বক্তব্য পাওয়ার পর ঘটনা মোড় নিতে থাকে অন্যদিনে। পরিবার দাবি করে, সিলেট মহানগর পুলিশের বন্দর বাজার ফাঁড়িতে পুলিশের নির্যাতনে প্রাণ হারান রায়হান।
ওই রাতেই পুলিশকে অভিযুক্ত করে সিলেটের কোতোয়ালি থানায় হেফাজতে মৃত্যু আইনে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন নিহতের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি। পরদিন রায়হানের মৃত্যুর ঘটনায় সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (উত্তর) শাহরিয়ার আল মামুনকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সিলেট মহানগর পুলিশ।
এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলে রায়হানকে ফাঁড়িতে এনে নির্যাতনের প্রাথমিক প্রমাণ পায় কমিটি। এই তদন্ত কমিটির সুপারিশে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূইয়া, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটুচন্দ্র দাসকে সাময়িক বরখাস্ত এবং এএসআই আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়।
এ মামলায় ২০ অক্টোবর পুলিশ কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস ও ২৪ অক্টোবর কনস্টেবল হারুনুর রশীদকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছে পিবিআই।
এই ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলনমূখড় হয়ে পরে সিলেট। সিলেট মহানগর পুলিশকে নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এই সমালোচনার মুখে বুধবার (২২ অক্টোবর) মহানগর পুলিশের (এসএমপি) কমিশনার গোলাম কিবরিয়াকে বদলি করা। আর এই ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত আকবর হোসেন ভূইয়া ১২ অক্টোবর থেকে পলাতক রয়েছেন।
তদন্তে নেমে পুলিশ হেফাজতে রায়হান উদ্দিনের মৃত্যু ও নির্যাতনের প্রাথমিক সত্যতাও পায় তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটি জানতে পারে রোববার ভোর ৩টার দিকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে সুস্থ অবস্থায় রায়হান আহমদকে আনা হয় বন্দরবাজার ফাঁড়িতে। সেখানে ফাঁড়ি ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়ার নেতৃত্বেই তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে সকাল সাড়ে ৬টার দিকে রায়হানকে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সকাল ৭টার দিকে মারা যান তিনি।
রায়হান নগরের আখালিয়ার নেহারিপাড়া এলাকার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে। তিনি স্টেডিয়াম মার্কেট এলাকায় এক চিকিৎসকের চেম্বারে সহকারি হিসেবে কাজ করতেন