“সংসার মানে সংসার ভাঙ্গা
সংসার মানে তুমি,
সংসার মানে সংসার ভাঙ্গা
বেদনার জলাভূমি। ”
ষোলো বছর সংসার করেছি।কখনো একসাথে বসে চা খাইনি। কখনো অপেক্ষা করিনি,সে এলে চা খাবো।কারণ তার বিকেল কাটতো আমাকে ছাড়াই।দুপুর কিংবা রাতে ভাত খেতাম না, সে খাওয়ার আগে। সেটাও নিতান্তই আমারই তাগিদে। কখনো একসাথে ভাতও খাইনি। সে ছিলো রাজা,আমি আর আমার সন্তান প্রজা।
কতোদিন এমনও হয়েছে যে,ও খেয়ে বাকি খাবারগুলো জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছে, যেন আমরা না খেতে পারি। এই কথাটা যখন কেউ শুনে ওরা বিশ্বাসই করতে চায় না। আমার মেয়ের পনেরোতে আমি ওকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য হই। আর কোন মতেই পারছিলাম না। ছেলের বয়স তখন সাত। ছেলে অনেক কিছুই মনে করতে পারে না। মেয়ের তো সবই মনে আছে। মেয়েটা যখন অনার্সে পড়ে সম্ভবত তখন আমার প্রথম বইটা বের হয়। ওখানেই অনেক কথা লেখা ছিল আমার। মেয়ের জন্য একজন পাত্র এক পরিচিত ভাই নিয়ে এসেছে। ওরা ফোনে কথা বলে মাঝেমাঝে। আমি তখন স্কুল শেষ করে একটা, দুইটা কখনো বা তিনটা টিউশনি করে রাত দশটায় বাসায় ফিরি। একদিন ফেরার পর মেয়েটাকে দেখি কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলা অবস্থায় কান্নাকাটি করছিল। পরে জানতে পারি সেই ছেলেটি অর্থাৎ বিয়ের পাত্র আমার মেয়েকে ফোন করে জিজ্ঞেস করছিল, কথাগুলি কি সত্যি যা আমার বইতে লেখা ছিল? মেয়ের কথা শুনে সেই ছেলেটিও নাকি ফোনের ওপাশ থেকে খুব কান্নাকাটি করছিল। যদিও পরে ভিন্ন এক কারণে সেই ছেলেটির সাথে আমার মেয়ের বিয়ে হয়নি। সেটা অন্য গল্প। এই গল্পের সাথে সেটার কোনো সম্পর্ক নেই। এমনও হয়েছে একদিনের কথা একদিনের ছবি আমার চোখে কে বা কারা যেন লাগিয়ে দিয়েছে আঠা দিয়ে। কিছুতেই যা সরাতে পারি না স্মৃতির চোখ থেকে। দুপুরে খাবার পর আরও চার টুকরো ইলিশ মাছ ভাজা ছিল রাতে খাবার জন্য। আমার সেই সোয়ামী প্রভুটি খাওয়ার পরে আমি আমার মেয়ে যখন রান্না ঘরে ঢুকলাম খাওয়ার জন্য , দেখি ভাত মাছ কিছুই পাতিলে নেই। তবে চার টুকরা মাছের কাঁটা কড়াইতে রাখা আছে।আমার বোনরা,কলিগরা বলতো তোরা আগে খেয়ে নিস,কিন্তু কখনোই সেটা করতাম
না। না,ভালোবেসে নয়,ঘৃণায় উপোস দিতাম তবু আগে খেতাম না।
ও কে?
ও ছিলো আমার স্বামী, সমাজ যাকে বৈধ বলে।
আজকাল বিকেল গুলি বড়ো বেশীই একা লাগে,ফাঁকা লাগে।বুকের ভেতর ফাঁকা লাগে। এই লাগাটা আগেও ছিলো,তখন সন্তান নিয়ে ব্যস্ততাও ছিলো।তাই খারাপ লাগাটাও কাটিয়ে উঠতে পেরেছি।ছুটতে পেরেছি।এখন আর পারি না।এখন ছুটতে পারি না আর ! বিকেল বেলা, সন্ধ্যা আর রাত্রিবেলা এমনকি সকাল এবং দুপুরবেলা,সত্যি বলতে কী সারাটাবেলাই তোমায় ঘেঁষে থাকতে ইচ্ছে কর খুব। একসাথে বসে চা খাওয়া,সকাল দুপুর খাবার খাওয়া… ইচ্ছে করে খুব!
ছেলেটাকে সেদিন বলছিলাম, ভালো লাগে না কিছুই। বললো, মামাকে এনে দিলেই বুঝি ভালো লাগবে?
ছেলে দুষ্টামি করছিলো।
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে ফোনের লাইনটা কেটে…।
তুমি কে?
তুমি এখন অন্য কারো বর। সমাজ যাকে আমার জন্য অবৈধ বলে। অথচ সমাজ বৈধ বলে সে ছিল আমার বর। যাকে নিয়ে আমার একটু সুখের স্মৃতিও নেই।
একটা সময় দাসপ্রথা সতীদাহ প্রথা বৈধ ছিল সামাজিকভাবে। সময়ের প্রয়োজনে, যুগের দাবিতে বৈধ-অবৈধ সংজ্ঞাটাও একদিন পাল্টে যাবে। পাল্টে যাবে আত্মীয় আর অনাত্মীয়ের সংজ্ঞাটাও। আমি সেই সময়ের জন্য বুক পেতে থাকি। মন পেতে থাকি, কান পেতে থাকি।
একদিন এই বৈধ অবৈধের সংজ্ঞাটা পাল্টে যাবে জানি। সেদিন কিন্তু আমি থাকবো না।
– শামা আরজু, লেখক