প্রায় ৫৪ দিন নিখোঁজ থাকার পর সাংবাদিক কাজলকে যেদিন পাওয়া গেলো; ঠিক সেদিন থেকে ক্রমে ক্রমে লেখক মুশতাক, রাষ্ট্রচিন্তার নেতা দিদার আর কার্টুনিস্ট কিশোরকে তুলে নেয়া; আটক করার ঘটনাগুলো আইন শৃংখলা রক্ষা বাহিনীর খুব সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশে আইন-শৃংখলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক; সেই ব্রিটিশ আমল থেকে একই রকম তিক্ত রয়ে গেছে। করোনাকালে আক্রান্তের লাশ ফেলে বেওয়ারিশ করে যখন আত্মীয় স্বজনেরা চলে গেছে, আইন-শৃংখলা রক্ষা বাহিনী তখন স্বজনের মত লাশ দাফন করেছে। করোনাকালে জনগণের সেবা করতে গিয়ে অনেক এই নিরাপত্তা বাহিনীর অনেক সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকের মৃত্যুও হয়েছে।
করোনাভাইরাস ইউনিফর্ম চেনে না; দেশের নাগরিক কাজল, মুশতাক, দিদার, কিশোর আর এলিট ফোর্সের যারা তাদের তুলে নিয়েছে; এরা সবাই করোনার কমন এনিমি। করোনার চোখে এরা সবাই শত্রু।
‘এক মিনিটের নাই ভরসা; বন্ধ হবে রঙ তামাশা” জাতীয় সংগীত গেয়ে করোনা দখল করে নিয়েছে গোটা পৃথিবী। দেশে দেশে সবাই করোনা উপনিবেশ থেকে মুক্তির জন্য লড়াই করছে। বাংলাদেশ এখন করোনা সাম্রাজ্যের একটি করোদ- রাজ্য মাত্র। একটু গভীরভাবে ভেবে দেখুন; আমাদের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন। দখলদার করোনাবাহিনী দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের পর স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পুরো হবার প্রাক্কালে; আমরা কার্যত করোনা আধিপত্যের বিরুদ্ধে মুক্তির যুদ্ধে রয়েছি।
এরকম একটি ভয়াল পরিস্থিতিতে; যেখানে করোনা সাম্রাজ্য দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশ; তখন শেখ হাসিনা সরকার করোনা হামলায় কার্যত ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েছে। আগামি বছর দুয়েকের মাঝে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন উদ্ভাবিত হবার সম্ভাবনা দেখছেন না সংশ্লিষ্ট গবেষক মহল।
আর করোনাভাইরাস, নিজের গঠনশৈলী প্রতিনিয়ত বদলায়; এর নিজস্ব প্রুফ রিডার রয়েছে; যারা মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিততে সক্ষম এমন করোনা সৈনিকদের যুদ্ধে পাঠায়, দুর্বল সৈনিকদের মেরে ফেলে। কাজেই পরিবর্তনাশীল ঘাতক ভাইরাসের বিরুদ্ধে আজকের ভ্যাকসিন আগামিকাল অকার্যকর। তার মানে পৃথিবী কার্যত করোনা সাম্রাজ্যের উপনিবেশে পরিণত হলো। এই করোনা সৈনিক আপনার আমার দরোজায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে; হত্যার জন্য ওঁত পেতে আছে।
এরকম মৃত্যু বিভীষিকার মাঝে, কে সরকারের বিরুদ্ধে কী বললো না বললো; কে প্রধানমন্ত্রীকে অসম্মান করে ফেলেছে ইত্যাদি বিষয়গুলোর আর কোন মূল্য নেই। ক্ষমতায় করোনা; এখন ক্ষমতা হারানো সরকার সমালোচনা বা করোনার সামনে অসহায় মন্ত্রীসভার ভাবমূর্তি; এসব বিষয় কতোটা অবাস্তব দেখাচ্ছে; করোনার শক্তিমত্তা ও শৌর্যবীর্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকায়; হাসিনা-সরকারের “ক্ষমতা সংরক্ষণ উপদেষ্টারা” এখনো ভাবছেন তারা ক্ষমতায় আছেন।
ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের লড়াই তো করোনার বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রী আর আমার মা একই প্রজন্মের মানুষ। এখন তো আমি আমার মায়ের প্রজন্মের জীবন ভিক্ষা চাই করোনার কাছে। কারণ উনাদের প্রজন্মের জন্য দুটো ঝুঁকি; করোনাভাইরাস আর করোনা- পরিস্থিতি সংক্রান্ত ট্রমা।
করোনা দেশ ও পৃথিবী দখল করার পর কোন মানুষের সঙ্গে বৈরিতা অনুভব করিনা। কাউকে শত্রু মনে হয় না। ফেসবুকে আগে যে লোকটিকে সহমত ভাই, কট্টর ইসলামপন্থী, কট্টর হিন্দুত্ববাদী বলে অপছন্দ করতাম; এখন তাদের দেখলেই করোনার কাছে তাদের প্রাণ ভিক্ষা চাই।
বাংলাদেশ সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে; একাত্তর সালের যুদ্ধটা ছিলো পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে; আর বিশ বিশের যুদ্ধ করোনার দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। একাত্তরে মানুষের বিরুদ্ধে মানবরূপী দানবের লড়াইয়ে “রাজাকার” ছিলো। কিন্তু করোনা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গণহত্যাবাহিনী। এর আল-করোনা বা করোনা-সংঘ নামে কোন রাজাকার বাহিনী প্রয়োজন নেই।
সুতরাং এখন মানুষের নিঃশর্ত ঐক্য প্রয়োজন। এর মাঝেও এলিটফোর্সের লোকজনকে সরকারের যে লোকটি লেলিয়ে দিচ্ছে, যে লোকটা ত্রাণের চাল চুরি করছে, নিম্ন মানের মাস্ক সরবরাহ করছে, গার্মেন্টস খুলে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়াচ্ছে,যে বণিক সমিতি দোকান খুলে করোনা ভাইরাসকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, এরা অভ্যাসবশত করোনা-রাজাকার হয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাস তাদেরকেও ক্ষমা করবে না। এরা যেহেতু করোনার থাবার কাছে চলে যায় লোভের পাপে সক্রিয় থাকতে গিয়ে; করোনা-পাপে করোনাই এদের বধ করবে।
ইরানের যে ধর্মীয় নেতা বলেছিলেন, করোনাভাইরাস মুসলমানদের আক্রমণ করবে না; তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। ভারতের যে ধর্মীয় নেতারা দাবি করেছিলেন, গো-মূত্র করোনাভাইরাসকে মেরে ফেলবে; তিনিও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে যে নারী “লক ডাউন খুলে” দেবার দাবি জানিয়ে খোলার পক্ষে আন্দোলন করছিলেন, তিনিও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশে করোনায় হিন্দু মরেছে, মুসলমান মরেছে, আওয়ামী লীগ মরেছে, বিএনপি মরেছে, ধনী মরেছে, গরীব মরেছে; আসলে মানুষ মরেছে; আশংকা করি ; আরো অসংখ্য মানুষ মারা যাবে।
কাজেই বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারক মহলকে করোনা-আক্রান্ত এই জরুরি অবস্থাকে গভীরভাবে বুঝতে হবে। রাজনীতি-ধর্ম-বিজ্ঞান-এলিট ফোর্সের অস্ত্র কোন কিছু দাঁড়াতে পারছে না; করোনা সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। এটাই আজ ও আগামির নির্দয় বাস্তবতা।
বাংলাদেশে এক শ্রেণীর মানুষ আছে; যারা মরতে মরতেও অন্যের ক্ষতি করতে চেষ্টা করে। এটা দক্ষিণ এশিয় “কাঁকড়া” স্বভাবের উত্তরাধিকার।
এলিট ফোর্সের অভিজ্ঞ গুম-কারিগরেরা জানেন, উনারা যখন কাউকে “পাতাল-জেলে” আটকে রাখেন; তখন মানুষটা মৃত্যুভয়ে আর্তনাদ করে। যতক্ষণ প্রাণ আছে; ততক্ষণ মার-ধোর-নির্যাতনের মাঝেও তার সে আর্তনাদ থামানো কঠিন হয়।
করোনা মানব-সমাজ পুরোটাকেই গুম করে; করোনা কারাগারে আটকে ফেলেছে; মৃত্যুর ভীতি আর আতংকে মানুষ অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিনই। কারণ করোনার হাত থেকে বাঁচার ক্ষমতা মহাপরাক্রমশালী এমেরিকারই নেই; বাংলাদেশ সেখানে কত অসহায় এতো সহজেই অনুধাবন করতে পারার কথা।
ফেসবুকে করোনাকালে সরকারের বিরুদ্ধে আর্তনাদ ও সমালোচনা বেড়েছে। করোনার বিরুদ্ধে আর্তনাদ করে তো লাভ নেই। সেই ফেসবুক সমালোচনার সূত্র ধরে অন্যসময়ের মতো সরকার বিরোধীদের তালিকা তৈরি-গ্রেফতার; এগুলো দেখে আশংকা হয়, নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের যারা এই তালিকা তৈরি ও গ্রেফতার; মানে উইচ-হান্টিং-এর কাজে নিয়োজিত; তারা নিশ্চিতভাবেই করোনা-আতংকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সুস্থ মস্তিষ্কে লড়তে গেলে মানসিক সুস্থতা ও স্থিতি অত্যন্ত জরুরী।
একটা বিষয় খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে; ক্ষমতায় দখলদার করোনা; মৃত্যু প্রতিমুহূর্তে তাড়া করে ফিরছে ভি আই পি হাসপাতালের রোগী থেকে কোন হাসপাতাল না পাওয়া রোগী প্রত্যেককে। কিংবা যার মধ্যে করোনার কোন লক্ষণ নেই; তার শরীরে বসে করোনা মিটি মিটি হাসছে। করোনার এই হত্যা রিসংসার মাঝে অযথা “আওয়ামী লীগ করোনার চেয়ে শক্তিশালী” এমন ভাবাটা আত্মঘাতি। আত্মহনন নাকি বেঁচে থাকার লড়াই সেটা ভাবতে হবে এখনি।
- মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক
Editor-in-Chief, E-South Asia