এই না হলে বিজেপি! জন্মলগ্ন থেকেই আদ্যন্ত বেনিয়া-নির্ভরশীল একটি দল।
হিন্দুত্ব বিজেপির মার্গদর্শক আরএসএস-এর মতাদর্শের ভিত্তি, কিন্তু পাশাপাশি বিজেপির দলীয় রাজনীতির বিপণনের কৌশল-ও বটে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র দেখাতে চাওয়ার জন্যে, কুশিক্ষিত বর্ণহিন্দু ও ব্রাহ্মণদের বংশানুক্রমিক চেতনার গভীরে থাকা মুসলিম-বিদ্বেষকে অনুঘটক হিসেবে ব্যবহার করে নিজের প্রতি আকর্ষণ করতে, নিজের সামাজিক-রাজনৈতিক ভিত্তি প্রসারিত করার লক্ষ্যেও।
মানুষের সমস্যা-সংকট-বিপর্যয় ব্যবসাদারদের কাছে অতিরিক্ত মুনাফা ঘরে তোলার সুযোগ। করোনা-সংক্রমণ আতঙ্কে আতঙ্কিত মানুষ যখন লকডাউনপর্বে বাধ্যতামূলক গৃহবন্দি, সেই আতঙ্ককেই পুঁজি করে বেওসাদাররা চাল-ডাল-তেল থেকে শুরু করে বিড়ি-সিগারেট প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে মুনাফা লুটতে ব্যস্ত। যেন-তেন-প্রকারেণ মুনাফা অর্জন অর্থাৎ সুযোগের সদ্ব্যবহার বেনিয়া-দর্শনের মূল কথা।
ট্রেনে-প্লেনে-ক্যাবে ‘ডায়নামিক ফেয়ার’, ‘সার্জ প্রাইসিং’-এও এই বেনিয়া-দর্শনেরই প্রতিফলন।
এমএলএ-এমপি কেনার মধ্যেও এই বেনিয়া-রাজনীতির বাস্তব অনুশীলন।
এই বেনিয়া-রাজনীতিরই ধারাবাহিকতায়, করোনা বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের মহানায়ক ঘোষিত ২০ লক্ষ কোটি টাকার ‘ত্রাণ’ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল কৃষিক্ষেত্রের সংস্কার। চাষিদের সাহায্য করার অজুহাতে। গতকাল কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর ঘোষণায়।
‘কী রয়েছে কৃষিক্ষেত্রের সংস্কারে?
এক, স্বাধীনতার পরে কালোবাজারি ও বেআইনি মজুত রুখতে যে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন তৈরি হয়েছিল, তা সংশোধন করা হবে। চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, গম, ভোজ্য তেল, তৈলবীজ যত ইচ্ছে মজুত করা যাবে। একমাত্র যদি না মহামারি বা জাতীয় দুর্যোগ আসে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সংস্থা, রফতানিকারী সংস্থাগুলিকে একসঙ্গে অনেক খাদ্যশস্য মজুত করতে হয়। নিয়ন্ত্রণ উঠে যাওয়ায় তাদের ব্যবসা বাড়বে, আরও লগ্নি আসবে। দুই, রাজ্যে রাজ্যে কৃষিপণ্য বাজার কমিটি আইন মেনে চাষিরা শুধু নির্দিষ্ট মান্ডিতে লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ীদের কাছেই ফসল বেচতে পারেন। রাজ্যের আইনের বদলে কেন্দ্র নিজের আইন আনবে। তাতে চাষিরা যেখানে ভাল দাম পাবেন, সেখানেই ফসল বেচতে পারবেন। তিন, বেসরকারি সংস্থাগুলি যাতে চাষিদের ঠকাতে না পারে তার জন্য আইনি কাঠামো তৈরি হবে।’ (আবাপ ১৬ মে ‘২০)
অর্থাৎ কৃষিপণ্যের ব্যবসাদার, সংগঠিত রিটেল ব্যবসায়ী সংস্থা অর্থাৎ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কর্পোরেট বেনিয়াদের একচেটিয়া ফাটকা-পুঁজির কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়া হল জাতীয় কৃষিপণ্যের বাজার। অতিমারীর কারণে অভূতপূর্ব এই বিপর্যয়ের সুযোগ নিয়ে।
পাশাপাশি কৃষি-বাণিজ্যকে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনতে উদ্যোগ নেওয়াও হল।
মহাজনী ঋণের ফাঁদে আটকে থাকা, সার-বীজ-কীটনাশকের নিরন্তর মূল্যবৃদ্ধিতে – ফড়ে-দালালদের অত্যাচারে বিপর্যস্ত ভারতের অধিকাংশ ক্ষুদ্র কৃষক ছোট জোতের মালিক, ভাগচাষি এই সংস্কারের ফলে উপকৃত হবেন?
সত্যিই বিশ্বাস করেন আপনি? ভক্ত নিশ্চিত!
সংস্কারের আসল মূল্য কিন্তু দেবেন ওইসব পণ্যের ক্রেতারা।
কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়
কলকাতা মে ২০২০