দারিদ্র্যকে মহান বলে প্রচার করা কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের দেশের গরীব বাবা-মায়ের উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। পুত্র বুলবুল বসন্ত রোগে মারা যাওয়ার পরে দরিদ্র পিতা নজরুল পুত্রের কবর দেওয়ার টাকার জন্য শিয়রে লাশ রেখে লিখেছেন-
বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে,
ঝড়া বন গোলাপের বিলাপ শোনে…
ছেলে ভোঁ-গাড়ি চড়তে চাইতো বলে মৃত পুত্রকে গোরস্থানে নিয়ে গিয়েছেন মোটরগাড়িতে চড়িয়ে! ভেবে দেখেন- দারিদ্র্য কি তাঁকে ‘মহান’ করেছিল?
করেনি বলেই বাঙালি দারিদ্র্যকে মহান বলার পাশাপাশি ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে’ও সজোরে মুখস্ত করে। বাঙালি জানে গাড়িঘোড়া চড়ে তবেই দারিদ্র্যকে মহান বলতে হবে!
কিন্তু এই দ্বিচারিতার খবর কোথায় পেতাম যদি নজরুল না জন্মাতেন?
এইদেশের জাতীয় কবি নিজের পুত্রের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মোহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ, কাজী অনিরুদ্ধ, কাজী সব্যসাচী। ভেবে দেখেন- কৃষ্ণের সাথে মোহাম্মদ, অরিন্দমের সাথে খালেদ! আপনি পারবেন ছেলেমেয়ের এমন নাম রাখতে? নাকি ভাবতেই ধর্মানুভুতিতে আঘাত লাগছে?
নজরুলকে নিয়ে দেখিয়ে বেশিরভাগ বাঙালিই বলে- আজ যদি নজরুল বেঁচে থাকতেন!
অথচ নজরুল বেঁচে থাকলে কি হতো? হয় ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টে মামলা খেতেন, নইলে ১৯২৩ সালে পাশ হওয়া ব্রিটিশ আমলের অফিশিয়াল সিক্রেসি এক্টে মামলা খেতেন রোজিনা ইসলামের মতো! আবিস্কার করতেন ব্রিটিশ রাজ নাই, কিন্তু ব্রিটিশ আমলের আইনসহ আরও গলা টিপে ধরার যাবতীয় আইন নামের বে-আইন আছে!
নজরুলকে ধারণ করার মতো ক্ষমতা আমাদের এখনো হয় নাই। কেবল কবরটাই আছে তাঁর এদেশে কিন্তু আত্মাটা নাই! যেদেশের স্বপ্ন তিনি দেখতেন, সেই অসাম্প্রদায়িক দেশ বারবার করে ভাগ হওয়া ভারতবর্ষে একটিও হয় নাই!
এখনো ধর্মের নামে মানুষের ঘর পোড়ে, জাতীয়তার নামে অন্যদেশের প্রতি অহেতুক ঘৃণাকেই দেশপ্রেম বলে প্রচারিত হয়, এখনো দুইদেশের কাঁটাতারে কিশোরী মেয়েটির লাশ ঝুলতে থাকে। কিন্তু নজরুল হেরে যান না, তিনি আমাদের কানে ফিসফিস করে বলেন-
পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি(এই রবি মানে সূর্য না, রবীন্দ্রনাথ), রয়েছে সোনার শত ছেলে।
প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!
হুমায়ূন আজাদ বলেছিলেন- সবাই যীশু হতে চায় কিন্তু ক্রুশবিদ্ধ হতে ভয় পায়!
নজরুল আমাদের ক্রুশবিদ্ধ যীশু, যিনি সত্য বলায় জেলে ছিলেন, হুলিয়া নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন পথে প্রান্তরে! যেমন লিখেছেন গজল, হামদ-নাত তেমনি কীর্তন! তাঁকে জাতপাত দিয়ে কীভাবে ভাগ করবেন?
তাই নজরুল মরে গিয়েও তোষামুদে আমলা, পদলেহকারী গামলাদের সর্বনাশ করতে বেঁচে ওঠেন, কারণ আমরা নিজেদের সর্বনাশ করতে বেঁচে থেকেই মরে গিয়েছি! এখানেই তাঁর কৃতিত্ব আর আমাদের ব্যর্থতা! বুঝলেন?
(ফেইসবুক পোস্ট ২৪ মে, ২০২১)
জান্নাতুন নাঈম প্রীতি: ফ্রি ল্যান্স রাইটার