আমাদের হাইস্কুলে পরিণয় মজুমদার ছিল ইঁচড়েপাকা। খুব ভালো কোবতে লিখতো। হাইস্কুলে থাকতেই তার কবিতার সুনাম বহুদূর ছড়িয়ে গিয়েছিল। জয়পুরহাট তখন মহকুমা। স্থানীয় গণ্ডি পেরিয়ে বগুড়া কিংবা রাজশাহীতেও তার নামডাক। স্কুলে থাকতেই কলেজ, ইউনিভার্সিটির মেয়েদের সাথে তার প্রেম, ডেট চলতো। স্কুল পেরুনোর আগেই পালিয়ে বিয়ে। মেয়ে নওগাঁ শহরের, রাজশাহী ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। এসএসসি পরীক্ষার পরই আমি জয়পুরহাট ছাড়ি। পরিণয়ের খোঁজ-খবর পেতাম না। পরে জেনেছি এসএসসি পাশ করার পর বগুড়ায় চলে গিয়েছিল সে। দৈনিক করতোয়ায় সাংবাদিকের চাকরি নিয়েছিল। জাহানারা ইমামের নের্তৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের সময় দেখা, জয়পুরহাটে। সম্ভবত রিপোর্টিং-এর কাজে এসেছিল। বউয়ের খবর জানতে চাওয়ায় মন খারাপ করে বলেছিল- বউ চলে গেছে।
এখনো কবিতা লিখিস?
হ, লিখি।
কোবতে লিখে পেট চলে?
চলে তো।
এতো গাঁজা খাস ক্যান?
নইলে কবিতা বেরুয় না।
এসব ছেড়ে ভালোকরে পড়ালেখা কর, ভালো চাকরি নে, বিয়ে করে সংসারী হ।
বিয়ের দরকার কী? আমার ভক্ত ম্যালা মাগি আছে, তাগো লাগাই তো।
ভক্ত মানে?
মানে বোঝস না? কবিতার ভক্ত।
তার সাথে আর কথা বাড়ানোর সময় সুযোগ ছিলনা। মিনা সুইটমিটের পেছনে ইস্কয়ার স্টুডিওর পাশের গলিতে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল। শহীদ ডা. আবুল কাশেম ময়দানে জাহানারা ইমামের ভাষণ দেয়ার কথা। আমরা তার প্রস্তুতি ও রেকি করতেই বেরিয়েছিলাম। মাঝখানে পরিণয়ের সাথে দেখা হওয়ায় খানিকটা সময় দিতে হলো। এদিকে জেলা প্রশাসন শহরে ১৪৪ ধারা জারী করেছে। পরিণয়ের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
অনেক অনেকদিন পর পার্বতীপুর রেলস্টেশনের পাশে মুক্তিযোদ্ধা হোটেলে ট্রেনের বিরতির ফাঁকে নাস্তা খেতে ঢুকবো, পেছন থেকে কে যেন ভরাটকণ্ঠে বলে উঠল-
অ্যাই সন্ধি! তুই এটি ক্যা?
আমাকে বলছেন?
তুকিই তো কওছোঁ।
ভাবলাম পাগল টাগল হবে হয় তো। পাত্তা না দিয়ে হোটেলে ঢুকে নাস্তার অর্ডার করে, টেবিলে বসে পড়লাম। আমার সামনের চেয়ারে সেও বসে পড়েছে। বকবক করেই যাচ্ছে।
চিনতে পারিস নি?
না।
আমি পরিণয়। পরিণয় মজুমদার। কবি।
তোর এই হাল কেন? কী খাবি, মেসিয়ারকে অর্ডার দে।
দু’জনে নাস্তা করে বেরুলাম। গোল্ডলিফ টানলাম একসাথে। আমার ট্রেনের ইঞ্জিন ঘুরিয়ে চলে এসেছে। দেরী করা আর সম্ভব না।
চলি দোস্ত।
এক প্যাকেট নাসিরগোল্ড সিগারেট কিনে দিবি দোস্ত?
নাসিরগোল্ড ক্যান? গোল্ডলিফ দিব। রুকস্যাক থেকে ২টা গোল্ডলিফের প্যাকেট এবং দুটো পাঁচশো টাকার নোট ওর পকেটে গুঁজে দিলাম।
পরিণয়ের চোখের কোণে জল চিকচিক করছিল। মানিব্যাগ থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে ওকে দিয়ে বললাম ফোন করিস, কথা হবে।
কখনো ফোন করেনি সে।
শেষ দেখা ভারতের পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট রেলস্টেশনে। তখন আমি বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে আত্মগোপনে থাকি। বাড়ি থেকে কোনো জিনিশপত্র দরকার হলে শিয়ালদহ থেকে গৌড় এক্সপ্রেস ট্রেনে বালুরঘাট হয়ে হিলি চেকপোস্টে যাতায়াত করতাম।
সন্ধ্যা ৬টার দিকে শিয়ালদহগামী ট্রেন ছাড়বে, প্লাটফর্মেই বিপরীতদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে ট্রেন। বিকাল ৩টা থেকে স্টেশনে অপেক্ষা করছি। মাঝে মাঝে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামছি সিগারেট টানতে।
হঠাৎ আমার নাম ধরে ডাক, একই কণ্ঠ। পেছন ফিরে দেখি পরিণয়। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। সত্যিই ভয় পেয়ে গেছি। সে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করছেনা তো? এখানে, ভারতের মাটিতে সে আমাকে ফলো করছে কী কারণে? সতর্ক হয়ে গেলাম। মুখে হাসি, মনে ভয় নিয়েই কথাবার্তা বললাম। জানালাম, ট্রিটমেন্ট করতে কলকাতায় যাচ্ছি।
কথা বলতে বলতে প্লাটফর্মের ওপর অনেকক্ষণ হাঁটাহাটি করলাম। ওর কথা জানালো, কুলির কাজ করে; এখনো নিয়মিত গাঁজা খায়। বলবো কী বলবোনা ভাবতে ভাবতে বলেই ফেললাম-
এখনো কবিতা লিখিস?
না রে দোস্ত। গাঁজা খাওয়ার পয়সাই জোটে না, কবিতা লিখবো কখন!
তোর বউ-বাচ্চা?
নাই। একা।
আমার নম্বরটা রাখ। মন চাইলে মিসকল দিস।
সেদিনও ট্রেনে চেপে বিদায় নিয়েছিলাম, পরিণয়ের কাছ থেকে। মালদহ স্টেশনে বিরতির পর আবারও ট্রেন চলতে শুরু করেছে। চোখে ঘুম ধরে এসেছে প্রায়। এমন সময় মোবাইলে কল। রিসিভ করলাম।
হ্যালো, সন্ধি? আমি পরিণয় দোস্ত! কবি পরিণয় মজুমদার।
ট্রেনের শব্দে তার কোন কথাই শুনতে পেলাম না।
– জোবায়েন সন্ধি
২৬ মে, ২০২০
বার্লিন, জার্মানি।