কার্গিল ব্রীজ (১ম, ২য় ও ৩য়), পোলঘাটের হাউক্কা, হতাল খালের বাঁশের সাঁকো:
নানা নামের মধ্যে কোনো নামই টিকে থাকেনি গন্যায়ারগো হাউক্কার কাছে।
যাহোক, কার্গিল ব্রীজ নির্মিত হয়েছিল হতাল (সাঁওতাল) খালের উপর। হরিশপুরে অবস্থিত নদী সিকস্তিতে অধুনা লুপ্ত সন্দ্বীপ টাউন রূপান্তরিত হয়ে সন্দ্বীপ পৌরসভা নাম ধারণ করে। তখনকার আইনের বাধ্যবাদকতায় সন্দ্বীপ টাউন হরিশপুরের অংশ হিসাবে গণ্য হলো। ফলে পৌরসভা হরিশপুরে থেকে গেলো ও অফিস আদালত চলে গেলো কমপ্লেক্সে। হরিশপুরের পয়স্তি ভূমিতে আবার টাউন গড়ে উঠতে পারে, সে স্বপ্ন দেখেছেন কেউ কেউ। মানুষের ঘুমে আত্মা বিচরণ করে। তাই স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে তো টাইম এন্ড স্পেস থাকে না।
টাউনের উত্তর দিক থেকে আসা পাকা রাস্তা দক্ষিণে এসে পোলঘাটে শেষ হয়, ওই শেষ হওয়া রাস্তা সংলগ্ন পশ্চিম পাশে আমাদের দোকান ছিল। ওখান থেকে কাঁচা পাকা ৩টি রাস্তা ৩ দিকে বাক নেয়, পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে।
পূর্বের বড় রাস্তাটি ছিল বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত দায়রা জজ আবু সুফিয়ান ভাইয়ের আব্বার দোকানের সামনে দিয়ে আমার চাচা মরহুম রুহুল আমিন তালুকদারের দোকান পর্যন্ত। সুফিয়ান ভাইদের দোকানটি আসলে একটি বড় সর আড়ত ছিল। চাচার নাম ছিল মরহুম অলি আহম্মেদ সওদাগর। হাসি খুশি মার্জিত বড় মাপের এই মানবের ডাক নামও ছিল। আমাকে ভাতিজা বলে ডাকতেন। আল্লাহ উনাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের সুউচ্চ বালাখানা যেন দান করেন: আজ রামাদ্বানের এই শুভ রজনীতে কায়মনবাক্যে এই দোয়া করি।
এই সুবিশাল আড়তে বস্তা প্রতি বা মন হিসেবে কমিশন ধার্য ছিল। যাদের সন্দ্বীপ টাউনে, টাউন বাজারে বা বাণী বাজারে স্থায়ী কোন দোকান ছিল না তারা বা রহমতপুর বাজার ও অন্যান্য হাট বাজারের মালামাল নিয়ে যেত চাচার কাছ থেকে।
অন্যদিকে ভোর সকালে যুগীরা ভারে করে চাল নিয়ে আসতেন এই ৩ রাস্তার মোড়ে বিক্রির জন্য। সকাল ৯ টার মধ্যে চাল বিক্রি না হলে, অবিক্রিত চাল রেখে যেতেন চাচার আড়তে। বিভিন্ন ব্যাপারী বা ছোট বড় দোকানীরা মালামাল কিনে নিয়ে যেতেন চাচার আড়ত থেকে। কোন কোন ব্যাবসায়ী সাম্পানে করে, পালতোলা নৌকা বা পরবর্তীতে ট্রলারে করে আনীত মালামাল আড়তে রাখতেন; তাদের জন্য এই কমিশন ভিত্তিক আড়ত একটি উত্তম ব্যাবস্থা ছিল। প্রাণ চাঞ্চল্যময় কোলাহলমুক্ত স্বচ্ছ পরিবেশ আজও যেন মনে হয়, এইতো গতকালের।
চাচার আড়তের সামনে ও ডায়ে বাঁয়ে কয়েকটি দোকান ছিল। কোনো কোনো দোকান সব সময় বন্ধ থাকত। অন্যগুলো খোলা থাকত। এই কঙ্কর বিছানো রাস্তা দিয়ে ওপারে রহমতপুরের দ্বিকোণ বিশিষ্ট রাস্তার সাথে কার্গিল ব্রীজ নির্মিত হল। বড়ো বড়ো ৩টি পাকা ব্লক দিয়ে নির্মিত হল কার্গিল ব্রীজ। ব্রীজে ফুটপাতও ছিল।
ঢালায় করা ২টি কলামের উপর ৩টি ব্লক বসানো হয়েছিল। চিটাগাং ঢাকার ফ্লাই ওভারের মত। ব্রীজটির নাম করণ করা হয়েছিল ১৯০২ সালে প্রতিষ্ঠিত কার্গিল হাই স্কুলকে কেন্দ্র করে। নির্মাণের কয়েক বছরের মধ্যে একদিন কাক ডাকা ভোরে ধপাস করে পরে গেল পুরো ব্রীজটি। রহমতপুর অংশের ভীম ও স্লোপটি স্বাক্ষী ছিল অনেক বছর। অন্য দু’টি স্লোপ ও ১টি ভীম আর কোনোদিনের জন্য গোচরী ভুত হয়নি কারোর।
এই কাঁচা পাকা রাস্তা দিয়ে একটি রাস্তা চলে যায় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সামনে দিয়ে ওয়াপদা রেস্ট হাউজের পূর্ব পাশের বাউন্ডারি দেয়াল ঘেঁষে পরবর্তীতে নির্মিত হওয়া কার্গিল ব্রীজ দ্বিতীয়টির দিকে। যেই ব্রীজের মাঝামাঝি বরাবর পাকিস্তানী বর্বরদের গুলিতে জাহিদ মোক্তার চাচা শহীদ হন। আরেকটি রাস্তা ওয়াপদা রেস্ট হাউজের সামনের গেইট হয়ে আমাদের বাসার দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে (তালুকদারদের) ঈদগাহ হয়ে সোজা হতাল (সাঁওতাল) খালের পাড় পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়। যেখানে এমএলভি নোঙ্গর করতে। সন্দ্বীপের পশ্চিমে ইস্টিমার ঘাটের আলাউদ্দিন, মনিরুল হক, রাঙা বালি ও রার আওলিয়ার যাত্রীদের ঘাট বা কুল থেকে ইস্টিমার পর্যন্ত আবার ইস্টিমার থেকে ঘাট বা কুল পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন করার জন্য এমএলভি ব্যবহার হতো। পাশাপাশি ভাড়ার বিনিময়ে নৌকাও ছিল।
এই ঘাটে মালামালবাহী সাম্পান, পালতোলা নৌকা ও ট্রলার আসতো চট্টগ্রামের চাক্তাই, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর ও খুলনাসহ অন্যান্য নৌ ঘাট থেকে। আমাদের চাচা জেঠারা গুদি ভাড়া উসুল করতো। ওই পাড়ের রহমতপুর অংশে আন্ধা বোট নোঙ্গর করতো গোডাউনের মাল খালাস করার জন্য। আন্ধা বোট ছিল কার্গো শীপের মত। ৩ থেকে ৫ টি পাল দিয়ে বাতাসের অনুকূলে বড় নদী বা সমুদ্র পাড়ি দিত। নদীর পাড়ে আসলে গুন্ টেনে ঘাটে নিয়ে আসা হতো। বোটের খেপ অনেক দিনের হতো, প্রায় দু’তিন মাসের। ‘টিয়া নাই মুঢে; যাইত চা বুঢে’ মানে হচ্ছে পরিবারের জন্য খাওয়া খরচ দিয়ে বোটের নাইয়া (নাবিক) হতে হতো। আন্ধা বোটের নাইয়া হাওয়া কম কথা নয়, অর্থের জাগান থাকতে হতো এই ধরণের ভিয়াজ্জুর জন্য। তা ছাড়া নব বধূর বিরহ তো আছেই।
১৯৫৮ সালে স্বৈরাচারী জেনারেল আয়ুব খান যুক্ত ফ্রন্টের হুসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা গ্রহণ করে। ১৯৬২ সালে আয়ুব খান পাকিস্তানের জন্য একটি খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে। সিলেট ও পার্বত্য চট্রগ্রামকে স্বায়িত্ব শাসন দিতে চেয়েছিল ঐ সংবিধানে। ১৯৬২ সালে আয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্রের ফর্মুলা দেয়। (পর্ব ২ এর) শিবলী ভাইয়ের আব্বা হলেন রহমতপুরের মরহুম এডিএম মহিদুল মাওলা ওরফে জামশেদ উকিল বিএ, এমএ, এলএলবি। আয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের সুফলে প্রদেশিক পরিষদের এমএলএ মনোনীত হয়েছিলেন সন্দ্বীপ থেকে। এমএলএ থাথাকাকালীন উনার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে একটি ছিল কার্গিল ব্রীজ।
সম্পর্কের দিক থেকে আমি বেকায়দায় আছি। জামশেদ উকিলের আব্বা মরহুম বড় মিয়া হলেন আমার আব্বার বন্ধু। আর উনার মেঝু ছেলে শামীম হলো আমার প্রাইমারি স্কুলের বন্ধু। সব দিক বিবেচনা করে ও উনার ছেলে মেয়েদের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতার কারণে আমি উনাকে চাচা হিসাবে সম্বোধন করছি। উকিল চাচা কেতা দুরস্ত ভদ্রলোক ছিলেন। পোলঘাটের রহমতপুর অংশে বাজার মসজিদ ছিল। রহমতপুর বাজার সকাল সন্ধ্যা বসতো। ওই মসজিদে জুমার খুৎবার আগে মসজিদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের ব্যাপার বাগ্মী বক্তব্য দিতেন । বিশেষ করে শবে বরাত ও শবে কদর রাতে।
কার্গিল ব্রীজ ২য় টি অচিরেই ভেঙে যায়। তারপর খেয়া নৌকাতে পারাপার আবার আরম্ভ হয়। এরপর দীর্ঘ দিন সাঁকো চলতে থাকলো। পাশা পাশি দুটো সাঁকো তৈরী করা হলো। একটি সাঁকো আসার জন্য; আরেকটি যাওয়ার জন্য। পরে বুদ্ধি করে একটি সাঁকো ২.৫-৩ হাত বাঁশের পাটাতন বানিয়ে পারাপার চলতে থাকে। এরপর আবার তৈরী হলো ৩য় ব্রীজটি। ৯১ এর জলোচ্ছাসের পর ভেঙে যাওয়া লোহার পাত, খাম্বা ও কাঠের নির্মিত ৩য় ব্রীজটি একটি নিদ্রিষ্ঠ স্থানে হেফাজতে রাখা হয়েছিল ।
এরপর পৌরসভার পশ্চিম পাশে প্রবাহিত হতাল খালের উপর ইটের ৪র্থ ব্রিজ তৈরী করা হলো। তাও টিকেনি। আবার পাশা পাশি সাঁকো তৈরি হলো গন্যায়ারগো হাউক্কা নামে। সন্দ্বীপ টাউনের তথা পৌরসভার সাথে সাথে ছায়ার মত চলতে থাকা ব্রীজগুলো বা সাঁকোগুলো, কোনোটায় টিকছে না। কেননা বয়োবৃদ্ধরা বলতে শুনেছি, জোউক্কার বাতাস লেগেছে; হতালে কোনো ব্রীজ বা সাঁকো টিকবে না। এমনকি ৩য় ব্রীজের আয়রন ও কাঠের তক্তাও হাওয়া হয়ে গেছে। হতাল খালে কিছুই টিকবে না; কেননা কোন এক ঘন কালো অমাবস্যায় জোউক্কাকে শ্রাদ্ধ দেয়া হয়নি বলে!
উকিল চাচার আরেকটি মহান কর্ম উল্লেখ না করে পারছি না। টাউন (বা বাণী) বাজারের প্রধান প্রবেশ পথে, বটা এমএলএফ ডাক্তারের চেম্বারে বিজয় রায় নামক একজন ইংরেজি টাইপিস্ট ছিলেন, বিয়ে করেননি, চিরকুমার, এভারগ্রিন ও স্বজ্জন ব্যাক্তি ছিলেন। তখন বাংলায় মনির অপটিমা সন্দ্বীপে আসেনি । উনাকে বর্বর পাকিরা ধরে নিয়ে এলো ওয়াপদা রেস্ট হাউসে কর্নেল হাফিজের কাছে। (পর্ব – ১ এ উল্লেখিত মেজর হাফিজ পরে কর্নেল হয়েছিল)। দূর থেকে দেখা গিয়েছিল, বিজয় দা’র পায়জামার ভিতরে ধর্ম সনাক্তকরণের ভীতিকর ও লজ্জাজনক পর্বটি। নির্ঘাত গুলি ও মৃত্যু। জামশেদ উকিল চাচা খবর পেয়ে ইংরেজিতে কথা বলে কর্নেল হাফিজের নক্কারজনক হিংস্র ধাবা থেকে উদ্ধার করতে পেরেছিলেন বিজয় দা কে। অন্তত বর্বর পাকিদের হাত থেকে একজন বাংলাদেশী বাঙালী রক্ষা পেলেন।
কোনো দিনই জানা হলো না, এর পরে বিজয় দা মাসীর বুকে মুখ লুকাতে পেরেছিলেন কিনা?
বাংলাদেশ সময় সকাল ৯ টা, তাং: রোববার, ২৪/৫/২০ইং।
——————————
লেখকের অনুরোধ: আশা করি, এই পর্বটি আপনাদের ভালো লেগেছে। লাইক ও কমেন্টের মাধ্যমে মতামত দিবেন, প্লিজ। ফলে ভুল শুধরে নিতে পারবো। আর এই পোস্টটি শেয়ার করে নিন আপনার অনলাইনের সোশ্যাল বন্ধুদের মাঝে। যাতে আগামী পর্ব থেকে উনারাও সরাসরি এই স্মৃতিচারণের সাথে যুক্ত হতে পারেন। সন্দ্বীপকে নিয়ে নস্টালজিয়া ও কেতাদুরস্ত সন্দ্বীপিয়ানা স্মৃতিচারণমূলক পরবর্তী পর্বের উপর ‘চোখ রাখুন’ – আগামী রোববার ৩১/৫/২০ইং, সময়: সকাল ৯ টা: পর্ব নং ৪, পোস্ট হবে ইনশাআল্লাহ।
শিরোনাম থাকবে: হতাল (সাঁওতাল) খাল, বিপ্লবী সাঁওতাল ও তাদের সন্দ্বীপে আগমন এবং কার্গিল হাই স্কুল।
আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে। ধন্যবাদ
স্মৃতিচারণে: শিব্বীর আহমেদ তালুকদার
আইনজীবী, সমাজ সংগঠক ও কথ্য ইতিহাস গবেষক।
sandwip21st@gmail.com