সন্দ্বীপ টাউনে সভা সমাবেশ (৬)
[ প্রাক কথন: এ লিখাটি বা পর্বটি ওরাল হিস্ট্রি বা স্মৃতিকথন, ইতিহাস নয়। তবে ইতিহাসবিদরা এই লিখা বা পর্বগুলো থেকে তথ্য-উপাত্তগুলো গবেষণার জন্য সূত্র বা রেফারেন্স উল্লেখপূর্বক এবং সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে শেয়ার করতে হলে পূর্ব অনুমতি নিয়ে উদ্ধৃতি বা লেখকের টাইম লাইন থেকে শেয়ার করতে পারবেন। গবেষক ছাড়া অন্যরা পর্যালোচনা এবং প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রে উদ্ধৃত করতে হলে লিখিত অনুমতি ব্যতিরেকে, আংশিক বা সম্পূর্ণ কোন ধরণের অনুলিপি করা যাবে না। বাংলাদেশ ও আর্ন্তজাতিক কপিরাইট আইন দ্বারা লেখক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। লিখিত অনুমতির জন্য ইমেইল: sandwip21st@gmail.com]
ভাসানী। মওলানা। মওলানা ভাসানী। লাল মাওলানা। মজলুম জন নেতা। আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ছোট কালের ডাক নাম ছিল চেগা মিয়া যিনি বড় হয়ে কিভাবে আব্দুল হামিদ খান ভাসানী হয়ে উঠলেন। আজকের এই ওরাল হিস্ট্রিটি তার নাতিদীর্ঘ জনশ্রুত দিয়ে লেখার কথা ছিল। সন্দ্বীপে উনার আগমনলগ্ন আমার স্মৃতিপটে একটু অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে। এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি কয়েক জন সন্দ্বীপের বিদ্গ্ধ ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছি। মওলানা ভাসানীর সন্দ্বীপে আগমন ও সন্দ্বীপবাসীদের মনে আজো কিভাবে তা রেখাপাত করছে, তার জন্য আমি অন্যদের ওরাল হিষ্টির উপর ভর করতে চেয়েছিলাম। এই ভর করতে গিয়ে কয়েক জনের তথ্য সূত্র মতে জানা যাচ্ছে যে, মওলানা সন্দ্বীপে এসেছিলেন ১৯৬৬/৬৮ সালের দিকে। কয়েক জন বলেছেন, মনে করতে পারছেন না। তাই আমি আর সেদিকে যাচ্ছি না। ভবিষ্যতের অপেক্ষায় রইলাম।
কি করেন নাই ভাসানী। কোন দিকে তার পদচারণা ছিল না। কি সমাজ, কি রাজনীতি, কি হক্কুল ইবাদ, কি হক্কুল্লাহ সহ জীবনের সব ক্ষেত্রে (১২ ডিসেম্বর ১৮৮০ – ১৭ নভেম্বর ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত) দীর্ঘ ৯৬ বছরে কি করেন নাই ভাসানী। কত কিছু শুরু করেছিলেন তিনি, কিন্তু শেষ করেছেন অন্য জন। শেষ করেছেন তারই কর্মী বা সহকর্মীগণ। যদিও রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও অনুরাগ পেয়েছেন অনেকের কাছ থেকে। কর্মী বা সহকর্মীদের থেকে যেমন ভালোবাসা পেয়েছেন, ঠিক তেমনি তাদের থেকে পরিত্যাক্ত হয়েছিলেন। ভাসানী আপোষহীন ছিলেন। এক সময়ের সহযোদ্ধাদের রাজনৈতিক কর্মের সমালোচনা করেছেন। প্রতিবাদও করেছেন রাজপথে।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুনে পূর্ববঙ্গের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। মওলানা ভাসানী সর্ব সম্মতিক্রমে এই রাজনৈতিক দলের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুল হক এবং যৌথভাবে যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও খন্দকার মোশতাক।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ভাসানী। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর সন্দ্বীপ ও তার আশে পাশের এলাকায় প্রলয়ঙ্কারী ঘুর্ণিঝড় হলে দুর্গত এলাকায় ত্রাণ ব্যবস্থায় অংশ নেয়ার জন্য ন্যাপ প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাড়ান। বললেন- ”ওরা আসেনি।” ১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৭১ এর মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রদান করেন এবং ১৮ জানুয়ারি ১৯৭১ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন।
ভাসানী রাষ্ট্রভাষা বাংলা আন্দোলনের কারণে গ্রেফতার হয়ে ১৬ মাস কারা নির্যাতন ভোগ করেন। পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৫৩ সালের কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি শের এ বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সাথে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নামে নির্বাচনী মোর্চা গঠন করেন। পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে ২৩৭ টির মধ্য ২২৮ টি আসনে বিজয়ের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল বিজয় অর্জন করে।
১৯৫৪ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলে মাওলানা ভাসানী সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বিরোধিতা করে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করার জন্য সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে যে খসড়া শাসনতন্ত্র বিল পেশ করা হয়, তাতে পাকিস্তানকে ইসলামিক রিপাবলিক বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, তখন মওলানা ভাসানী ঢাকার পল্টনের জনসভায় তার বিরোধিতা করে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছিলেন৷ যদিও ইসালামিক শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯০৭ সালে দেওবন্দ মাদ্রাসায় দুই বছর পড়েন।
কাগমারী সম্মেলনে ১৯৫৭ সালে ভাসানী বলেন, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের দ্বারা এইভাবে শোষিত হতে থাকলে পূর্ববঙ্গবাসী তাদের ‘’সালামু ওআলায়কুম’’ জানাতে বাধ্য হবে। ওই সম্মেলনে ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী সেই দাবি প্রত্যাখান করলে ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। একই বছরে ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ (ন্যাপ) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাসানী প্রকাশ্যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৬৭ সালে ন্যাপ বিভক্ত হলে চীনপন্থি ন্যাপের নেতৃত্ব দান করেন ভাসানী। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে মাওলানা ভাসানী বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য আসামীদের মুক্তি দাবি করেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান কর্তৃক আহুত গোলটেবিল বৈঠক প্রত্যাখান করে শ্রমজীবীদের ঘেরাও কর্মসূচী পালন করেন। আইয়ুব খান সরকারের পতনের পর নির্বাচনের পূর্বে ভোটের আগে ভাত চাই, ইসলামিক সমাজতন্ত্র কায়েম ইত্যাদি দাবি উত্থাপন করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বদলীয় চরিত্র দেয়ার উদ্দেশ্যে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে আট সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়, যার সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ওই উপদেষ্টা কমিটির সভায় বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতিরেকে অন্য কোন ভাবে রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণ যোগ্য হবে না।
স্বাধীনতার পর মওলানা ভাসানী ১৯৭২ সালের ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন ও সাপ্তাহিক হক কথা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তির বিরোধিতা করলেও আওয়ামী সরকারের জাতীয়করণ নীতি এবং ১৯৭২-এর সংবিধানের প্রতি সমর্থন দেন। মাওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ” আসাম আমার, পশ্চিমবঙ্গ আমার ত্রিপুরাও আমার। এগুলো ভারতের কবল থেকে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মানচিত্র পূর্ণতা পাবে না।”
১৯৭৩ সালে খাদ্যের দাবিতে ঢাকায় ১৫ই থেকে ২২ শে মে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ১৯৭৪ সালে হুকুমতে রাব্বানিয়া গঠন করেন। একই বছর জুন মাসে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলে টাঙ্গাইলের সন্তোষে গৃহবন্দি হন। ১৯৭৬ সালে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লং মার্চের নেতৃত্ব দেন। একই বছর খোদাই খিদমতগার নামে নতুন আর একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
ভাসানী ২ টি বই রচনা করেন ‘দেশের সমস্যা ও সমাধান’ এবং ‘মাও সে তুং-এর দেশে’। ভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে। ২০০৪ সালে বিবিসি জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি তালিকায় তিনি ৮ম হন। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের স্কুল পাঠ্যক্রমগুলোতে ভাসানীর জীবনী ও প্রবন্ধ সিলেবাসভূক্ত করা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।
ভাসানী ন্যাপের উদ্যোগে ১৯৬৩ সালে আইয়ুব বিরোধী সমাবেশের আয়োজন করা হয় খালপাড়ে। ন্যাপের কেন্দ্রীয় নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ বক্তৃতা করেন। সন্দ্বীপের ন্যাপ নেতা এ এল বি দুজা বক্তৃতা করেন। সাবেক এমপি এডভোকেট সামছুল হুদা ন্যাপ করতেন। পরে তিনি ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি হয়েছিলেন।
সন্দ্বীপের জনগণ ভাসানীকে পছন্দ করতেন তার সাধাসিধা জীবন যাত্রার জন্য। ভাসানী একবার ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছেন নামাজ আদায়ের মাধ্যমে। সাধারণ প্রকাশ ভঙ্গির মাধ্যমে তিনি বক্তৃতা করতেন। সাধারণ মানুষ ছিলেন কিন্তু অসাধারণ প্রকাশ ভঙ্গি ছিল তার বক্তৃতায় যা মেটার করতো।
প্রত্যেক দিন খবরের হেড লাইন পেতেন। লিড নিউজ হতো দৈনিক পত্রিকাগুলোতে। একবার কোনো পত্রিকায় তার নিউজ ছিল না। হকাররা পত্রিকা ফেরি করার সময় বলে উঠলো- ভাসানীর খবর নাই। ভাসানীর খবর নাই। ওই দিন কথিত আছে কোনো কোনো পত্রিকা ২ বার ছাপতে হয়েছিল। দৈনিক ইত্তেফাকও একই দিনে ২ বার ছেপেছিল।
ভাসানীর কাছে লোকজন আসতেন ঝাড় ফোক করার জন্য। উনি দোয়া ও দাওয়ায় দিতেন। উনার কাছে রুগীরা ঝাড় ফোকের জন্য আসলে মওলানা পানি পড়ার সাথে কয়েকটি টাকাও দিয়ে দিতেন।
কাকতালীয় ভাবে সন্দ্বীপের ভাসান চর ভাসানীর সাথে মিলে যাচ্ছে। ১৯২৯ সালে আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন ভাসানী। এরপর থেকে তার নামের শেষে ভাসানী শব্দ যুক্ত হয়। আমাদের ভাসান চরে আজ রোহিঙ্গা বসতি স্থাপনের যে পরিকল্পনা চলছে, সে পরিকল্পনার বিরুদ্ধে নিশ্চয় ভাসানী প্রতিবাদ, কর্মসূচি বা অনশন করতেন।
যেখানে অন্যায় সেখানে ভাসানী। আজ আমাদের এহেন ক্রান্তিলগ্নে ও কঠিন সময়ে একজন ভাসানীর বড় দরকার!
স্মৃতিকথনে: শিব্বীর আহমেদ তালুকদার
আইনজীবী, সমাজ সংগঠক ও কথ্য ইতিহাস গবেষক।
sandwip21st@gmail.com
—–
আরো বিস্তারিত জানার জন্য:
1. Uphoff, Norman Thomas, (1972)। The political economy of development : theoretical and empirical contributions। Ilchman, Warren Frederick,। Berkeley,: University of California Press। page 168।
2. সিরাজুল হোসেন খান, উপমহাদেশের সামাজিক রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত, ঢাকা, ২০০২, পৃ ১১৯
3. Politics – Political Parties — Muktadhara © Tito Scohel & Scyma Hesser May 2001
4. Coggin, Dan । “Prophet of Violence” page 41।
5. Mustafa, Sabir। “Listeners name ‘greatest Bengali'”। The Asian Age।
6. “Mujib, Tagore, Bose among ‘greatest Bengalis of all time'”। The Hindu।
7. Alamgir, Mohiuddin । “Bhashani dropped from Bangla textbooks”। New Age। Dhaka।
………
আশা করি, এই পর্বটি আপনাদের ভালো লেগেছে। লাইক ও কমেন্টের মাধ্যমে মতামত দিবেন, প্লিজ। কোনো রকমের তথ্য বিভ্রাট হলে ইনবক্সে ম্যাসেজ দিবেন বা ইমেইল করবেন। ফলে ভুল শুধরে নিতে পারবো। আর এই পোস্টটি শেয়ার করে নিন আপনার অনলাইনের সোশ্যাল বন্ধুদের মাঝে। যাতে আগামী পর্ব থেকে উনারাও সরাসরি স্মৃতিকথনের সাথে যুক্ত হতে পারেন। সন্দ্বীপকে নিয়ে নস্টালজিয়া ও কেতাদুরস্ত সন্দ্বীপিয়ানা স্মৃতিকথনমূলক পরবর্তী পর্বের উপর ‘চোখ রাখুন’ – ।
আগামী রোববার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ইং, আসছে
আমার দেখা সন্দ্বীপ (পর্ব নং ১৯)
শিরোনাম থাকবে: সন্দ্বীপ টাউনে সভা সমাবেশ (৭)
(এ বিভাগে ছাপা লেখার বানান রীতি ও লেখকের মতামত নিজস্ব, এ জন্য সোজা কথা ডট কম-এর কোন দায় নেই)