আগে শুক্রবারে যখন দূরের চেম্বারে যেতাম সচেতন রোগীরা প্রায়ই এক সপ্তাহ পর পরের শুক্রবারে ঔষুধের খোসা নিয়ে ফিরে এসে বলতো, আপনি কি লিখলেন আর ওরা কি দিল? আমাকেও ঔষধ বিক্রেতাকে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করতে হতো সে কেন আমি যা লিখেছিলাম তা না দিয়ে অখ্যাত কোম্পানীর ট্যাবলেট দিয়ে দিয়েছে।
জনাব মশিউল আলম একবার লিখেছিলেন, ”জিজ্ঞাসা চিকিৎসক বন্ধুদের কাছে: আমরা যদি এমন একটা আইন চাই যে রোগীর ব্যবস্থাপত্রে অষুধের ব্র্যান্ড নাম লেখা চলবে না, অবশ্যই জেনেরিক নাম লিখতে হবে, তাহলে কি আপনার আপত্তি থাকবে?”
আমার জবাব হলো, হ্যা, আপত্তি থাকবে। শুধু আপত্তি নয় ঘোরতর আপত্তি থাকবে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় জেনেরিক নাম লেখার পরিণাম হবে ভয়াবহ। আমি ভালো ব্র্যান্ডের ঔষধ লিখলেও দোকানদার চরম বাজে ঔষধ দিয়ে দেয়, আর জেনেরিক লিখলে তো তাদের পোয়াবারো।
এদেশে অনেকগুলি ঔষধ কোম্পানী আছে যাদের কার্যক্রম, ঔষধগুলির বিক্রী, বিপনন, মার্কেটিং শুধু গ্রামাঞ্চলের হাতুড়ে ডাক্তার, পল্লী চিকিৎসক ও ঔষধের দোকানগুলি ঘিরে। আমরা কেউ ঐসব কোম্পানীর বা তাদের ঔষধসমূহের নামও জানিনা। ওদের বিজনেসটা মুলত: কোয়াক ও ডিসপেনসারী নির্ভর। ভালো কোম্পানির কোন এন্টিবায়োটিক যদি ২৫ টাকায় কিনে ৩০ টাকায় বিক্রী করে ৫টাকা লাভ করে তবে ঐ আটাময়দা সুজি দিয়ে তৈরী অখ্যাত কোম্পানীর ঔষধ ৫ টাকায় কিনে ৩০ টাকায় বিক্রী করে লাভ করতে পারে ২৫ টাকা। রোগীর উপর এর প্রভাব অত্যন্ত নেতিবাচক। ঔষধ ক্রয়ের পিছনে পুরো পয়সা ব্যায় করেও রোগীরা কোয়াক ও ঔষধ বিক্রেতাদের লোভের বলি হয়। মাঝে মাঝে রোগীরা এমন সব ঔষধের খোসা নিয়ে আসে যার ও তার প্রস্তুতকারী কোম্পানীর নাম জীবনেও শুনি নাই। টাইফয়েডের রোগী, প্রেসকিপশনে ভালো কোম্পানীর ঔষধ লেখা অথচ তাকে সেটা না দিয়ে বিক্রেতা অধিক লাভের জন্য কোন এক পচা কোম্পানীর পচা ঔষধ গছিয়ে দেয়। ফল হয় মর্মান্তিক এমনকি মৃত্যুও।
জেনেরিক ও ট্রেড নাম নিয়ে একটা উদাহরন দেই। Paracetamol হলো জ্বর ও ব্যাথা নিবারনের ঔষধ। অর্থ্যাৎ ট্যাবলেটের ভিতর যে মুল উপাদান থাকে এর নাম Paracetamol। এই paracetamol কে দিয়ে তৈরী ঔষধকে এক কোম্পানি নাম দিয়েছে নাপা, অন্য কোম্পানি নাম দিয়েছে এইস, গাওগেরামের কোম্পানী Alkad নাম দিয়েছে Alkaparol, Pharmik কোম্পানী এর নাম দিয়েছ Anapol, Cosmo pharmaয় এর নাম Cpmol ইত্যাদি। এখানে Napa, ACE, Alkaparol, Anapol, Cpmol এসব কোম্পানীগুলির দেয়া Paracetamol এর trade বা বাজারী নাম। আর এ সবগুলোর ভিতরেই যেহেতু Paracetamol থাকে- Paracetamol এখানে generic বা মুল নাম। এখন আমি জেনেরিক নেম প্যারাসিটামল লিখতে বাধ্য হলে ঔষধ বিক্রেতা তাকে নাপা দিলেও সই, অখ্যাত ফার্মিক কোম্পানীর Anapol দিলেও সই- যে কোম্পানি বা ওষুধের নাম ডাক্তার বা অন্যরা জীবনেও শোনেননাই বা দেখেন নাই। লক্ষ্যনীয় যে, এই অখ্যাত কোম্পানি কিন্তু ওষুধ প্রশাসনের লাইসেন্সপ্রাপ্ত। ঠিক এই জায়গাটাতে ঔষধ প্রশাসন কর্তৃক মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকলে তখন আর জেনেরিক নাম- ট্রেড নাম নিয়ে চিকিৎসকদের কোন মাথাব্যথা থাকার কথা ছিল না। আমি লিখব ঔষধ রোগী পাবে আটা ময়দায় তৈরি পুরিন্দা- এটা কি ডাক্তার ও রোগী উভয়ের প্রতি অজ্ঞতাপ্রসূত অবিচার হলো না?
ধরুন আমি prescription এ Napa বা ACE লিখতে পারবোনা- Paracetamol লিখতে বাধ্য। তাহলে হবে কি লোভী ঔষধ বিক্রেতা আপনাকে ময়দা কোম্পানীর Alkaparol, Cpmol ইত্যাদি গছিয়ে দিলেও তাকে চার্জ করার কোন ground থাকবেনা কেননা সে তো paracetamol গ্রুপের ঔষধই দিয়েছে। আইনত: সে শতভাগ ঠিক। ঐ কোম্পানীগুলিও যে ঘুষপাতি দিয়ে ম্যানেজ করে লাইসেন্স রেজিস্ট্রেশন ঠিকই বাগিয়ে নিয়েছে। এখন এ Cpmol খেয়ে কিডনী নষ্ট হয়ে গেলে দোষ হবে ডাক্তারের। উল্লেখ্য পচা কোম্পানীর নানাবিধ ঔষধ খেয়ে গনহারে কিডনী নষ্ট সহ অন্যন্য ট্রেজেডি এই নিকট অতীতেই বেশ কয়েকবার ঘটেছে। নিকট অতীতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার “রিড” কোম্পানির কথা অনেকের মনে থাকতে পারে যাদের প্যারাসিটামল খেয়ে অনেক শিশুর কিডনি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এই ট্রেজেডির আগে কয়জন চিকিৎসক জানতো এই কোম্পানির নাম?
আমি আর জীবন রক্ষাকারী এন্টিবায়োটিক লিখতে গিয়ে Cefrtron বা Arixon লিখতে পারবোনা- লিখতে হবে generic নাম ceftriaxone। ঔষধবিক্রেতা দিয়ে দিবে অখ্যাত Astra কোম্পানীর Cefaz। আর এই ঔষধে infection নিধন হবে সে আশা করাটা এক হাস্যকর ব্যাপার। রোগী মানহীন ঔষধ খেয়ে মারা যাবে- দোষ হবে ডাক্তারের। আমার সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রোগীর জন্য আর ভাল কোম্পানীর ঔষধ choice এর ক্ষমতা থাকবেনা। ডাক্তার আর রোগী উভয়ের ভাগ্য নির্ভর করবে কোয়াক আর ঔষধ বিক্রেতার উপর।
ডাক্তারের তবু দায়বদ্ধতা আছে এই ঔষধ খেয়ে তার জ্বর না কমলে বা সংক্রমণে মারা গেলে চাপটা আবার তার কাছে ফিরে আসবে। কেননা রোগী গিয়ে ওষুধ বিক্রেতার কাছে কখনোই অভিযোগ করবে না কি ভাই কি ওষুধ দিলেন ব্যথা তো কমলো না, রোগী তো মরে গেল। তাদের সমস্ত অভিযোগ থাকবে প্রেসক্রিপশন লেখক চিকিৎসকের উপরেই।
আনাচে-কানাচে গজিয়ে ওঠা ঔষধ কোম্পানিগুলিকে লাইসেন্স দেওয়ার আগে তার মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করাটা তাই এই মুহূর্তের প্রধান কর্তব্য। তার আগে জেনেরিক নাম, ব্র্যান্ড নাম ধোয়া তোলাটা হবে নিতান্তই আত্মঘাতী।
আমরা এমন অনেক কোম্পানি ও ঔষধের নামও জানিনা যেগুলি পল্লী চিকিৎসক ও ঔষধ বিক্রেতাদের হাত ধরে শুধু টিকেই নেই, দুর্দান্ত ব্যবসা করেও চলছে।
সততা ও কঠোর মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির ওষুধের মধ্যকার কোয়ালিটি কাছাকাছি আনার ব্যবস্থা করুন। কথা দিচ্ছি জেনেরিক নাম লেখার প্রস্তাবনার প্রথম সমর্থনকারীটি হব আমি।
– ডা: আমিনুল ইসলাম, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক