বাংলাদেশের যে সব তরুণ দেশমাতৃকাকে পরাধীনতার শৃংখল মুক্তির জন্য ঘর ছেড়েছিলেন; নাসিম তাদের একজন। জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন মনসুরের ছেলে নাসিম ছিলেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রিয় মুখ। তাঁকে যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছেন, তাদের একজনের সঙ্গে সেদিন ফোনে কথা হচ্ছিলো।
যে কোন মিছিলে একজন মানুষের মাথা ফাটলেও সেটা ছিলেন নাসিম। এতো সরল আর আন্তরিক মানুষ যে মিছিলে গিয়ে পুলিশের লাঠিচার্জ কিংবা প্রতিপক্ষের হামলার মুখে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া; নিজের কী হবে তা চিন্তা না করা ‘ব্রেভহার্ট’ এই নাসিম।
এতো সহজ সরল মানুষের মৃত্যুতে ফেসবুকের হোমপেজে যেতে ভয় লাগছে কেন! কেন উনার জন্য শোকগাথা লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে; তরুণ পাঠকেরা; যারা দেশপ্রেমিক নাসিমের শৈশব-কৈশর-তারুণ্য-যৌবনের সততার কথা জানেন না; তারা মন্ত্রী নাসিমকে যেভাবে দেখেছেন; তাতে আমার লেখা তাদের কাছে সহমত ভাইয়ের স্তুতি পত্র; কিংবা মাজারের খাদেমের ভাটিয়ালি ভেউ ভেউ কান্না মনে হতে পারে।
গ্রীক নায়ক ইডিপাস কিংবা শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট-এর মত গৌরবময় জীবনে একটি হামারশিয়া বা হুব্রিস বা ভুল; তাদের ট্র্যজেডির চরিত্র করে তুলেছে যেভাবে; নাসিমের মতো বাঙালি বীরের জীবনও যেন কতকটা তেমনি।
১৯৭৫ সালে নাসিমের বাবা ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে হত্যা করেছিলো বাংলাদেশের প্রতিবিপ্লবীরা। দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে অনেক ত্যাগ স্বীকারের পরেও জাতীয় নেতা মনসুরকে জীবন দিতে হয়েছিলো স্বদেশী মানুষের হাতে। পিতার হত্যার ট্র্যাজেডি নাসিমের মাঝে যে “হ্যামলেট-কমপ্লেক্স” তৈরি করেছিলো; তাই বদলে যাওয়া নাসিমের মনোজগতের বেদনাগাথা। পিতার শ্রম ঘাম, নিজের বীরত্ব, দেশের জন্য জীবন বাজি রাখা নাসিমের জীবন; কখনোই সাদা বা কালো এই দুটির একটি রং-এ অনুধাবন করা অসম্ভব। সেইখানেই সত্যকে সাদা/কালো, আওয়ামী লীগ-বিএনপি, সত-অসত, ভালো -মন্দ, কালো-ফর্সা, লিকলিকে-পেটমোটা এরকম মোটাদাগে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে।
১৯৯৬ সাল পর্যন্ত নাসিম কেবল সাদা, সৎ, ভালো নায়ক। এরপর থেকে মন্ত্রী নাসিম কালো-অসত-মন্দ খলনায়ক। আর নাসিমের পুরো জীবন ধূসর ক্যানভাসে একজন ট্র্যাজিক হিরোর জীবন।
রাজনীতির নায়ক নাসিমকে নিয়ে বাংলাদেশ বেতারে ২০০১ সালে একটি অনুষ্ঠানে ইন্টারভিউ করার সুযোগ হয়েছিলো সেখানে কাজ করার সূত্রে। সে নাসিম আত্মীয়ের মতো উষ্ণ একজন নায়ক; যিনি প্রাণখুলে কথা বলেন, সন্তানপ্রতিমকে স্নেহাশিস দেন। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাংলাদেশ উদয়ের চিহ্ন দেখেন। নিজের সাফল্য- অসামর্থ্য অকপটে স্বীকার করেন। ক্যাপ্টেন মনসুরের আলো সে নাসিমের চোখে-মুখে প্রতিভাত।
এরপর নাইন ইলেভেনে বদলে যাওয়া বিশ্বরাজনীতির অভিঘাতে ২০০৪ একুশে অগাস্টে জঙ্গিদের হামলা হলে; স্প্লিন্টারের আঘাতে রক্তাক্ত নাসিম শরীর দিয়ে আগলে রাখেন ১৯৭৫-এ দেশের মানুষের হাতে প্রাণ দেয়া মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে। ইতিহাসের এই দে-জাভুঁতে নাসিম পৃথিবীর সেই চিরন্তন ভাইয়ের চরিত্র; যে জীবন দিয়ে বোনকে রক্ষা করতে প্রস্তুত। শরীরে গেথে যাওয়া স্লিন্টারের ক্ষত চিহ্ন; আর বেদনা মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত নাসিমকে কষ্ট দিয়েছে।
এই মহান নাসিমকে নিয়ে আমি তির্যক রচনা লিখেছি; স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন কালে দুর্নীতির অভিযোগ তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত হওয়ায়; উনার ছেলের নিউইয়র্কে বিশাল সম্পদ কেনার ওপেন সিক্রেট; সেই হামারশিয়া বা হুব্রিস; যা নাসিমকে ট্র্যাজিক হিরোতে রূপান্তর করেছে।
জিয়া-এরশাদ-খালেদার মন্ত্রীসভার স্বাস্থ্যমন্ত্রী; সে আমলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আমলাদের দুর্নীতি; অথচ “সফল মানুষ”-এর তকমা পাওয়া দেখেছেন নাসিম। তাকে তার জীবনে অনেকবার শুনতে হয়েছে, পলিটিকস করে লোকে জমিদার হইয়া গেলো; আর তুমি বোকা নাসিম পৈতৃক জমি বিক্রি করে রাজনীতি করো।
যে দেশপ্রেমিক সরল নাসিমকে সমাজ “সফল মানুষ” হতে দুর্নীতিতে অনুপ্রাণিত করেছে; সেই সমাজই আজ নাসিমের “দুর্নীতির আলাপে” এক একজন পোপ হিসেবে হাজির হবে।
তাঁর মৃত্যুর ট্র্যাজিক ক্ষণে মনে হয়েছে, উনার পরিবার উনাকে দুর্নীতিতে জড়িয়ে যেতে ঠেলে দিয়েছে সেরকম অভিযোগ তোলা অনৈতিক; কিন্তু উনাকে সাবধান করা; ক্ষয়ের পথ থেকে সরিয়ে আনার প্রচেষ্টা থাকা জরুরি ছিলো। কারণ নাসিম তো বাংলাদেশের নেতৃত্বের আইকন; সেই আইকন ভেঙ্গে গেলে; রাজনীতিতে নবীন যারা তারা কাকে অনুসরণ করবেন।
নাসিম যেন সেই ট্র্যাজিক হিরো ইডিপাস, যে জীবনে সব কাজ ঠিক করেছিলো; একটি কাজ ভুল হয়েছে। নেতা নাসিম সব কিছু ঠিকঠাক করলেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে একটি ভুল করেছেন দেশমাতৃকার সঙ্গে।
নাসিম একটি সারাজীবনের গৌরবের প্রতীক। কিন্তু দুর্নীতিতে ভেঙ্গে পড়া স্বাস্থ্যখাতের অক্ষমতায়, দেশের সাধারণ মানুষ বিনা হাসপাতাল, আই সি ইউ, ভেন্টিলেটর, স্পেশালাইজড হাসপাতাল, ভি আই পি হাসপাতাল, এম্বুলেন্স, হেলিকপ্টার কিছুই না পেয়ে নরোত্তমের মতো হাসপাতালের সামনে “ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা-র ভঙ্গিতে মরে গেলে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সন্তান সম্ভবা মা ভ্যানগাড়িতে সন্তান প্রসব করলে; বাংলাদেশ অনিশ্চিত স্বাস্থ্য-মঙ্গা ক্যারাভানের যাত্রী হয়ে পড়ে। তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমের অক্ষমতা; রাজপথের লড়াকু পুলিশের বেয়নেট চার্জে, জঙ্গির গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে ক্ষত-বিক্ষত নাসিমের ব্রেভ হার্ট -এর রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অনুতাপ তাকে যেন সপাপবিদ্ধ করে। তার ব্রেণস্ট্রোক করে। উনি দীর্ঘ কোমায় চলে যান। তারপর ভালো-মন্দ বিচারের ওপারে চলে যান। নক্ষত্রের পতন ঘটে।
ব্যর্থ স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে নাসিমের মৃত্যুতে উল্লাসের মধ্যে কোন বিপ্লব নেই; জনমৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তির কফিনে জুতা ছুঁড়ে বীর হবার প্রতিহিংসা প্রবণ সমাজ কখনো সভ্যতার আলোয় পদার্পণ করতে পারেনা। পাপকে ঘৃণা করো পাপীকে নয়। অপরাধকে ঘৃণা করো অপরাধীকে নয়; এরকম প্রাচীন উপকথা অনুসরণ করে; একদা জলডাকাতের দেশ নেদারল্যান্ডস আজ অপরাধ মুক্ত; সেখানে কোন কারাগার নেই; এর প্রয়োজন নেই আজ।
যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা মানুষের সংশোধনের মাধ্যমে আমরা সভ্য মানুষ তৈরি করতে আমরা শিখবো না; ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সমাজ নরভোজি রয়ে যাবে; কারো মৃত্যুতে ফেসবুকে শকুন নামবে।
নাসিম তরুণদের জন্য তার সাদা জীবনের দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণা। নাসিম-এর বাকি অর্ধেক জীবন, আগামির নীতিনির্ধারক ও নাগরিকদের জন্য সাবধানতা। নাসিম যেন গভীর ঘুমের ঘোরে শৈশবে সিরাজগঞ্জ বাজারে গিয়ে দেখা মুদি দোকানির পেছনে ঝুলিয়ে রাখা বাণী চিরন্তনীর ঝাপসা স্মৃতির মেঘে বৃষ্টি নামান,
এমন করে গড়তে হবে জীবন
মরণে হাসবে তুমি; কাঁদবে ভুবন।
– মাসকাওয়াথ আহসান
সাংবাদিক, সাংবাদিকতার শিক্ষক
Editor-in-chief, E-SouthAsia