সোজা কথা ডেস্ক রিপোর্ট : প্রশ্নবিদ্ধ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের ফলে সংসদীয় কার্যক্রমে বিশেষত আইন প্রণয়ন, বাজেট প্রণয়ন এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে একচ্ছত্র ক্ষমতার চর্চা আরও জোরদার হয়েছে। অন্যদিকে নিয়মরক্ষার প্রধান বিরোধী দল হওয়ায় সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় তাঁদের জোরালো ভূমিকার ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। সংসদীয় কার্যক্রমে আইন প্রণয়ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলেও আইন প্রণয়নের আলোচনায় সংসদ সদস্যদের কম অংশগ্রহণ, অনাগ্রহ ও দক্ষতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। ‘পার্লামেন্টওয়াচ: একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম থেকে পঞ্চম অধিবেশন’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষ্যে আজ এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে উল্লিখিত পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এছাড়া, প্রমাণসহ অভিযোগ থাকলেও সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে স্পিকারের জোরালো ভূমিকার এবং অধিকাংশ সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যকর জবাবদিহি ও উন্মুক্ততার চর্চায় ঘাটতি এবং আইন প্রণয়নসহ জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের উদ্যোগ দেখা যায়নি। পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ও লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে সংসদে আলোচনার ক্ষেত্র সন্তোষজনক নয় বলে মন্তব্য করে সংস্থাটি। এ প্রেক্ষিতে সংসদকে অধিকতর কার্যকর করতে ১২ দফা সুপারিশ প্রদান করেছে টিআইবি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোরশেদা আক্তার ও নিহার রঞ্জন রায়। গবেষণাটি তত্ত্ববধান করেন একই বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম। সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম।
টিআইবির ধারাবাহিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে একাদশ জাতীয় সংসদের ওপর এটি প্রথম প্রতিবেদন, যেখানে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর সময়কালে অনুষ্ঠিত প্রথম থেকে পঞ্চম অধিবেশনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। গবেষণায় রাষ্ট্রপতির ভাষণ, আইন প্রণয়ন, জনপ্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহিতা সম্পর্কিত কার্যক্রম, সংসদ কার্যক্রম ব্যবস্থাপনা, সংসদীয় উন্মুক্ততা এই পাঁচটি মূল নির্দেশকসহ জেন্ডার প্রেক্ষিত এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট নির্দেশকসমূহের ভিত্তিতে সার্বিক পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে।
গবেষণার মূল পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে যে, একাদশ জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার শরীক দল ৮৯ শতাংশ, প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ৭ শতাংশ এবং অন্যান্য বিরোধী সদস্যরা ৪ শতাংশ আসনে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। সরাসরি নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্যে পুরুষ ৯২ শতাংশ ও নারী ৮ শতাংশ; যা সংরক্ষিত আসনসহ যথাক্রমে ৭৯ শতাংশ ও ২১ শতাংশ। সদস্যদের মধ্যে ব্যবসায়ী ৬১ শতাংশ, আইনজীবী ১৩ শতাংশ, রাজনীতিক ৫ শতাংশ ও অন্যান্য ২১ শতাংশ। উল্লেখ্য, প্রথম সংসদে ১৮ শতাংশ সদস্যের পেশা ছিল ব্যবসা। সদস্যদের একাংশ তাদের হলফনামায় সঠিক তথ্য (আয়ের উৎস, সম্পদের পরিমাণ, নির্বাচনী ব্যয় ও ব্যয়ের উৎস ইত্যাদি) প্রদান করেন নি এবং ২১ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা ছিল। একাদশ সংসদের পাঁচটি অধিবেশনের ৬১ কার্যদিবসের সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় হয়েছে জনপ্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত কার্যক্রমে (৩১ শতাংশ), যেখানে আইন প্রণয়নে (বাজেট ব্যতীত) মাত্র ৯ শতাংশ সময় ব্যয় করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনা পর্বে সদস্যদের বক্তব্যে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং যুক্তিসঙ্গত বিতর্কের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। সরকারদলীয় সদস্যদের বক্তব্যে নিজ সরকারের আমলের বিভিন্ন কাজের ও পদক্ষেপের প্রশংসা প্রাধান্য পেলেও সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যা, অনিয়ম-দুর্নীতির মত বিষয় তুলনামূলকভাবে কম প্রাধান্য পেয়েছে। অন্যদিকে বিরোধীদলীয় সদস্যদের বক্তব্যে সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যা, যেমন ব্যাংক খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি, সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি সত্ত্বেও দুর্নীতি হ্রাসে পদক্ষেপের ঘাটতি, আয় বৈষম্য বৃদ্ধি, বেকার সমস্যা, নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের তদন্তভিত্তিক সুপারিশ বাস্তবায়নে পদক্ষেপের ঘাটতি, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’Ñ এর বিতর্কিত ধারাসমূহ বাতিলের মত বিষয় উঠে এসেছে।
আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে বিল উত্থাপন এবং বিলের ওপর সদস্যদের আলোচনা ও মন্ত্রীর বক্তব্যসহ একটি বিল পাস করতে গড়ে প্রায় ৩২ মিনিট সময় ব্যয় হয়, যেখানে প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২০১৯ সালে ১৭তম লোকসভায় প্রতিটি বিল পাসে গড়ে প্রায় ১৮৬ মিনিট ব্যয় হয়। অধিকাংশ সংসদীয় কমিটিতে বিলের ওপর আলোচনায় ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে মাত্র ৪ শতাংশ সংসদ সদস্য (৩৫০ জনের মধ্যে ১৪ জন) বিলের ওপর নোটিস দিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন। বাকি সদস্যদের ভূমিকা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী বক্তব্য ও মতামত উপস্থাপনের ক্ষেত্রে সদস্যদের একাংশের দক্ষতার ঘাটতি এবং অধিকাংশ সদস্যের পূর্বপ্রস্তুতির ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। বিল পাশের ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে সরকারি দল একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। বাজেট আলোচনায় সরকারি ও বিরোধী উভয়দলীয় সদস্যের বক্তব্যেই খেলাপি ঋণ, ব্যাংক খাতে অব্যাহত ভর্তুকি ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার হ্রাস, অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হলেও তা সংশ্লিষ্ট নীতি-নির্ধারকদের কাছে প্রাধান্য পায়নি। ‘অর্থবিল-২০১৯’ এর ওপর বিরোধীদলীয় সদস্যদের জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাবও কন্ঠভোটে নাকচ হয়।
অন্যদিকে সরকারদলীয় ও প্রধান বিরোধীদলীয় সদস্যদের একাংশ প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব সমর্থন করেছেন, যদিও তা অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধান-পরিপন্থি। বাজেটের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর সুনির্দিষ্ট সংশোধনীর প্রস্তাব থাকলেও উল্লেখযোগ্য কোনো সংশোধনী ছাড়াই ‘অর্থবিল-২০১৯’ সংসদে পাস হয়।
জনপ্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহিতা সম্পর্কিত কার্যক্রমের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্র্বে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও প্রকল্প সম্পর্কিত প্রশ্ন বেশি উত্থাপিত হয়েছে এবং সদস্যদের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল। অন্যদিকে মন্ত্রীদের প্রশ্নোত্তর পর্বে সদস্যদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম ছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশ্নোত্তর পর্বে একইসাথে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও প্রশ্নকর্তা সদস্যদের একাংশের অনুপস্থিতির কারণে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। জরুরি জন-গুরুত্বসম্পন্ন বিষয়ে নোটিসের ক্ষেত্রে দেশের সমসাময়িক জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোচনার সুযোগ না পাওয়ায় সদস্যদের একাংশ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অনির্ধারিত আলোচনা পর্বে অন্যান্য বিরোধী সদস্যরা সমসাময়িক বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার দাবি করলেও তা প্রাধান্য পায়নি। পাশাপাশি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব পর্বে একজন সরকারদলীয় সদস্য তামাকজাত দ্রব্যের ওপর প্রচলিত স্তরভিত্তিক মূল্যের পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট করারোপ করার দাবি জানিয়ে সিদ্ধান্ত প্রস্তাব উত্থাপন করলে তা নজিরবিহীনভাবে দুইবার ভোট গ্রহণের মাধ্যমে বাতিল হয়। এছাড়া, জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো চুক্তি ছাড়া সম্পাদিত সকল আন্তর্জাতিক চুক্তি রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সংসদে উপস্থাপন করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও এই পাঁচটি অধিবেশনে এ ধরনের কোনো চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়নি।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী সংসদ অধিবেশনে সদস্যদের উপস্থিতির বিবেচনায় পুরুষ সদস্যদের গড় উপস্থিতি ছিল ২২ শতাংশ, যেখানে নারী সদস্যদের উপস্থিতি ছিল ৮৫ শতাংশ। অন্যদিকে সংসদ নেতা সংসদ অধিবেশনের ৯২ শতাংশ কার্যদিবস এবং বিরোধীদলীয় নেতা ৪৮ শতাংশ কার্যদিবস উপস্থিত ছিলেন। প্রধান বিরোধীদলীয় বা অন্যান্য বিরোধী সদস্যরা সংসদ বর্জন ও ওয়াকআউট করেন নি। তবে প্রতি কার্যদিবসে গড়ে ১৯ মিনিট কোরাম সংকট ছিল এবং সার্বিকভাবে মোট কোরাম সংকট ছিল ১৯ ঘন্টা ২৬ মিনিট, যা মোট সময়ের ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। মোট কোরাম সংকটের প্রাক্কলিত অর্থমূল্য প্রায় ২২ কোটি ৮ লক্ষ ৬৩ হাজার ৬২৭ টাকা।
সংসদীয় কমিটির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয় যে, একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনে সকল সংসদীয় কমিটি (৫০টি) গঠন করা হয়। কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী প্রতি মাসে কমপক্ষে একটি সভা করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও অধিকাংশ কমিটি তা পালন করেনি। প্রতি মাসে ন্যূনতম একটি করে সভা করেছে সরকারি হিসাব ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটি। কেবলমাত্র একটি সভা করেছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটি। পিটিশন কমিটি, কার্যপ্রণালী-বিধি ও বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত কমিটি কোনো সভা করেনি। অনেক কমিটিতে সদস্যদের (সভাপতিসহ) কমিটিসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততা বিদ্যমান থাকায় এবং গত সরকারের ১৫ জন মন্ত্রীকে সভাপতি করার ফলে স্বার্থের সংঘাতের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষকরে গত সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বে যেসব মন্ত্রী ছিলেন তাদেরকেই সেসব মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি করা হয়েছে। কোনো কোনো সংসদীয় কমিটির সদস্যদের একাংশের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম ও বিধি-বহির্ভূত সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ ছিল। সর্বোপরি সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করার সুযোগ থাকলেও তা প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর ছিল না।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচনকালীন মহাজোটের একটি দল প্রধান বিরোধী দল হওয়ায় সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় তাদের জোরালো ভূমিকার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষত, প্রধান বিরোধী দল সতর্কতার সাথে সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছে। আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে প্রধান বিরোধী দলের সদস্যরা তুলনামূলক বেশি সক্রিয় থাকলেও তা প্রত্যাশিত পর্যায়ের ছিল না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রধান বিরোধীদলীয় সদস্যরা সরকারদলীয় সদস্যদের সাথে একাত্ম হয়ে অন্যান্য বিরোধী সদস্যদের কঠোর সমালোচনা করেছেন ও তাদের বক্তব্য প্রদানে বাধা সৃষ্টি করেছেন। সংসদ অধিবেশনে সংসদ সদস্যদের যথাযথ আচরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদেরকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক শব্দের ব্যবহার অব্যাহত ছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সদস্যদের বক্তব্যে অসংসদীয় ভাষা (কটূক্তি) ব্যবহার বন্ধে স্পিকার নীরব ছিলেন। সংরক্ষিত নারী আসনের একজন সরকারদলীয় সদস্যের পাবলিক পরীক্ষায় অসাধু উপায় অবলম্বন এবং একজন ‘অন্যান্য বিরোধী দলীয় সদস্য’ শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি করে তা নিয়ম-বহির্ভূতভাবে বিক্রি করলেও তাঁদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
সংসদীয় উন্মুক্ততার চর্চা ক্ষেত্রে সংসদে উত্থাপিত আইনের খসড়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত করার প্রচলিত পদ্ধতি বিশেষত জনমত যাচাই-বাছাই এবং সংসদীয় কমিটি কর্তৃক জনমত গ্রহণের চর্চা লক্ষ্য করা যায়নি। সংসদীয় কার্যক্রমের কার্যবিবরণীসহ কমিটির প্রতিবেদন সহজলভ্য ছিল না, বিশেষকরে সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনগুলো সংসদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়নি। সংসদীয় কার্যক্রমে জেন্ডার প্রেক্ষিত বিবেচনায় নারী সদস্যদের উপস্থিতির হার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে আইন প্রণয়ন, প্রতিনিধিত্ব ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় নারী সদস্যদের ভূমিকা এখনো অনুল্লেখ্য। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, একাদশ সংসদের প্রথম পাঁচটি অধিবেশনে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়ন সম্পর্কিত আলোচনা তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে। তবে এই পাঁচটি অধিবেশনের বিভিন্ন পর্বে সংসদ সদস্যরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসডিজির বিভিন্ন অভীষ্ট ও লক্ষ্যমাত্রার সাথে সম্পর্কিত বিষয়ের ওপর আলোচনা করেছেন। সার্বিক বিবেচনায় এসডিজি বাস্তবায়নে সংসদে আলোচনার ক্ষেত্র এখনো সন্তোষজনক নয় এবং এ বিষয়ে সংসদ সদস্যদের আগ্রহের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “অষ্টম ও নবম সংসদে সংসদ বর্জনের যে সংস্কৃতি, যা দেশবাসীর কাছে অগ্রহণযোগ্য ও হতাশাব্যঞ্জক একটি বিষয় ছিল। সেটি দশম ও একাদশ সংসদে অনেক চড়া দামে বন্ধ হয়েছে। এর জন্য এত বেশি মূল্য দিতে হয়েছে যে, মাথা ব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান সংসদে পদ্ধতিগতভাবেই একটি কার্যকর বিরোধী দলের অনুপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে। এর ফলে সংসদ কার্যকর হওয়ার যে মূল সূত্র, একটি কার্যকর বিরোধী দল, তা বর্তমান সংসদে অনুপস্থিত। প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত নির্বাচনের একটি সংস্কৃতি আমাদের এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা রদবদলের সম্ভাবনা দূরীভূত হয়েছে, তারই প্রভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি জাতীয় সংসদের মধ্যে। এরই ধারাবাহিকতায় একাদশ জাতীয় সংসদে এক দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যারিষ্ঠতা এবং সংসদীয় কার্যক্রমে এক দলের একচ্ছত্র সুযোগ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। ফলশ্রুতিতে সংসদের যে মৌলিক দায়িত্ব, আইন প্রণয়ন তথা আইনের সংস্কার, জনপ্রতিনিধিত্ব ও সরকারের জবাবদিহিতা এই তিনটি ক্ষেত্রেই প্রত্যাশিত ভূমিকা আমরা দেখতে পাচ্ছি না, এবং সেটির সম্ভাবনাও ক্রমাগত বিলুপ্ত হতে দেখা যাচ্ছে।”
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, “ ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বে নির্বাচনী মহাজোট যেটি হয়েছিল, তারই একটি দলকে প্রধান বিরোধীদল হিসেবে পরিচিতি পেতে হয়েছে। সরকারকে জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে এই প্রধান বিরোধী দলের বাস্তব ও জোরালো ভূমিকা আমরা দেখতে পাইনি। সংসদের মৌলিক যে ভূমিকা অর্থাৎ আইন প্রণয়নে সরকারি ও বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের মোটাদাগে আগ্রহ ও অংশগ্রহণ কম। অনেক ক্ষেত্রে দক্ষতা ও সার্মথ্যও কম। সেটিরই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। সংসদীয় কমিটিসমূহ কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করেছে এরকম দৃষ্টান্ত বিরল। সংসদীয় গণতন্ত্র, সুশাসন, দুর্নীতি প্রতিরোধ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং শুদ্ধাচার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সংসদীয় কমিটিসমূহের যে অপরিহার্য ভূমিকা, তা কার্যকর হওয়ার কোনো দৃষ্টান্ত নেই। একইসাথে সংসদীয় উম্মুক্ততার চর্চা কখনই খুব একটা ছিল না, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।”
ড. জামান বলেন, “স্পিকারের ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রেই কেবল আনুষ্ঠানিক মাত্রায় রয়েছে। এমনকি প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অভিযুক্ত সদস্যদের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি স্পিকারের অবস্থান থেকে। সংসদে আলোচনায় টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টসমূহের কতিপয় বিষয় পরোক্ষভাবে আসলেও বাস্তবে এসডিজিকে সামনে রেখে সুনির্দিষ্ট কোনো আলোচনা বা উদ্যোগ দেখা যায়নি। বিশেষ করে অভীষ্ট-১৬ যেখানে কার্যকর, জবাবদিহি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্টানের কথা বলা হয়েছে, সেক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা ও আলোচনা আমরা দেখতে পাইনি। তবে এটাই স্বাভাবিক, কারণ যে প্রতিষ্ঠান নিজেই কার্যকর আছে কী-না, এ জাতীয় আত্মবিশ^াসের ঘাটতি বিদ্যমান, সেখানে সর্বস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মতো বিষয়সমূহ আলোচিত হবে সার্বিকভাবে আমরা তা আশাও করতে পারিনি।”
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণের আলোকে সংসদকে অধিকতর কার্যকর করার লক্ষ্যে টিআইবি ১২ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করেছে। উল্লেখযোগ্য সুপারিশসমূহ হলোÑ সংসদকে কার্যকর করার স্বার্থে জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাস্তবিক অর্থে অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে হবে; সদস্যদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন ও ‘সংসদ সদস্য আচরণ আইন’ প্রণয়ন করতে হবে; সংসদীয় কার্যক্রম এমন হবে যেখানে সরকারি দলের একচ্ছত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার পরিবর্তে কার্যকর বিরোধী দলের অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত হবে; সদস্যদের কার্যকর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে; সংসদে অধিকতর শৃঙ্খলা রক্ষাসহ অসংসদীয় ভাষার ব্যবহার বন্ধে স্পিকারকে বিধি অনুযায়ী রুলিং প্রদান ও অসংসদীয় ভাষা এক্সপাঞ্জ করার ক্ষেত্রে আরও জোরালো ভূমিকা নিতে হবে; এসডিজি’র বাস্তবায়নসহ আন্তর্জাতিক সব চুক্তি আলোচনার জন্য রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সংসদে উপস্থাপন এবং জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে প্রকাশযোগ্য নয় এমন বিষয় ব্যতীত অন্যান্য আন্তর্জাতিক চুক্তির বিস্তারিত সংসদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে; আইনের খসড়ায় জনমত গ্রহণের জন্য অধিবেশনে উত্থাপিত বিল সংসদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।সংসদীয় কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধির জন্য পিটিশন কমিটিকেও কার্যকর করতে হবে; কোনো কমিটিতে কোনো সদস্যের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া গেলে উক্ত কমিটি থেকে তাঁর সদস্যপদ বাতিল করতে হবে; সরকারি হিসাব সম্পর্কিত কমিটিসহ জাতীয় বাজেটে তুলনামূলকভাবে বেশি আর্থিক বরাদ্দপ্রাপ্ত শীর্ষ দশটি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিসমূহের মধ্যে অর্ধেক কমিটির সভাপতি হিসেবে বিরোধীদলীয় সদস্যদের মনোনয়ন দিতে হবে; কমিটির সভার প্রদত্ত সুপারিশের আলোকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থা, এবং ব্যবস্থা গৃহীত না হলে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা লিখিতভাবে কমিটির পরবর্তী সভায় (বিধি অনুযায়ী এক মাসের মধ্যে) জানানোর বিধান করতে হবে; এবং সংসদ সদস্যদের সম্পদের প্রতি বছরের হালনাগাদ তথ্যসহ সংসদের বাইরে তাদের বিভিন্ন কার্যক্রমের তথ্য স্বপ্রণোদিতভাবে উন্মুক্ত করতে হবে।
পুরো অনুষ্ঠানটি দেখতে
লিংকে ক্লিক করতে পারেন।