ঈদের দিনের সকাল বেলার প্রথম ফোন মৃত্যুর সংবাদ দিয়ে। আমার মায়ের খালাতো বোন, আমেনা খালা আর নেই। পরী তো দেখি নাই, বর্ননায় যেরকম শুনেছি সেরকমই আমার এই খালা। আর সেই তাঁকে রেখেই যখন তাঁর স্বামী তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর ভরা যৌবনে অন্য আরেকটা বিয়ে করলেন খালা তখন আর মেনে নিতে পারেননি। তারপর থেকেই খালা অনেকটাই অস্বাভাবিক। সংসার বলতে কি জিনিস তিনি আর সেটা বোঝেন না। সারাদিন বই নিয়ে পড়ে থাকেন। ঘরের কোনো কাজ নাই, এমন মেয়ে বই পড়া মেয়ে মানুষটাকে সমাজ ঠিক নিতে পারে না। তাই খালা দিনে দিনে আরও অস্বাভাবিক হয়ে ওঠেন। আমার কৈশোরে খালাকে আমি এমন দেখেছি। সেই কৈশোরে এমন খালার প্রতি আমার অন্যরকম একটা আকর্ষণ জন্মেছিলো। সেই আকর্ষণ ছিলো খালার মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। মাত্র দিন চার-পাঁচ আগেই খালা আমাকে যখন ফোন দিয়েছিলেন, তখন আমি সিএনজি অটোতে স্কুলের একটা সমস্যা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছিলাম। পথে খালার ফোনটা ধরতে পারি নাই। পরে যে ফোন দিবো সেটাও আর মনে নেই। আমার একটা মাত্র মাথায় হাজার রকমের চাপ, আরও কয়েক হাজার বছরের নির্যাতন। শারীরিক কিংবা মানসিক সবই। কতো আর মনে থাকবে!
আজ সকালে প্রথম ফোনটা পেলাম খালার মৃত্যু সংবাদ নিয়ে। তাঁর মেয়ে জামাই ফোন করলেন। মেয়ে জামাইয়ের ফোন থেকেই বেশিরভাগ সময় ফোনটা করতেন তিনি। যদিও আমি কেটে দিয়ে ফোন করতাম। আমার প্রতি আকর্ষণটা কেন ছিল খালার কখনো প্রশ্ন করা হয়নি। আমাকে প্রায়ই ফোন করতেন। আমি ভুলভাল কখনো কখনো মনে পড়লে খুব কমই ফোন দিয়েছি। মনে আমার পড়তো খুবই কম কিংবা যখন মনে পড়ে তখন হাজার রকমের ব্যস্ততা। যখন সময় থাকতো তখন মনে থাকত না কিংবা সময় থাকত, মনেও থাকতো যখন একসঙ্গে, তখন হয়তো ফোনে ব্যালেন্স ছিল না। আমার হাজারটা সমস্যা মেনে নিয়ে খালা বেঁচে থাকবেন কেন, কতদিন আর এত অবহেলায় মানুষ বেঁচে থাকে! খুবই সম্ভ্রান্ত বংশের মেয়ে ছিলেন খালা এটুকু জানতাম। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক জনাব তাজউদ্দীন এর মৃত্যুর পর জোহরা তাজউদ্দিনের বিয়ে হয়েছিল আমার খালুর সাথে। আমেনা খালার মায়ের মৃত্যুর পর জোহরা তাজউদ্দিনকে বিয়ে করেছিলেন আমার খালু। আমেনা খালার তিনজন মা ছিলেন তবে একই সাথে নয়। একটা মানুষকে তার সময়ে রেখে বিচার করতে হয়। তাই খালু নিয়ে আমার খুব একটা মাথা ব্যথা ছিল না। খালার বই পড়া রোগের কারণে আমার অন্যরকম একটা শ্রদ্ধাবোধ ছিল। আপন খালাদের সাথে যেটা কখনোই ছিল না। আমার মায়ের আপন বোনদের আমি বরাবরই এড়িয়ে চলেছি।গোঁড়ামির জন্য, ধর্মান্ধতার জন্য। আমার বড় খালাকে আমার বাবা ঘষেটি বেগম ছাড়া কথাই বলতেন না। ছোটবেলায় খুব একটা বুঝতে পারিনি। বুঝলাম যখন তখন দেখলাম, বাবা আসলে মিথ্যা বলেননি। যাইহোক প্রসঙ্গ পাল্টে যাচ্ছে। মৃত্যুর সংবাদ শুনে বুঝেছি করোনায় মারা যাননি।স্ট্রোক করে মারা গিয়েছেন। এখন করোনায় মারা গেলেও কেউ কেউ গোপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। সেটা সামাজিক চাপ জনিত কারণে আমি মনে করি। আমরা বড় অসভ্য এখনো। সভ্যতা মানেই প্রযুক্তির ব্যবহার নয়। শিক্ষা যেমন সিলেবাস মুখস্ত করা নয়। গাদা গাদা বই পড়াও নয়, এমনকি গাদাগাদা বিজ্ঞান বই পড়াও শিক্ষা নয়।শিক্ষা সম্পূর্ণ অন্য জিনিস।শিক্ষা একরকম আলো যা সবাই ধারণ করে না,লালনও করে না। সেরকম শিক্ষিত আমরা হতে পারিনি। দিনে দিনে আমি চরম হতাশাবাদী একটা মানুষের পরিণত হচ্ছি, যা হতে আমি চাইনি কখনো। একসময় তুমুল স্বপ্ন দেখতাম। সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতাম। সেই স্বপ্নের লক্ষ্যে কাজ যে কিছুই করিনি কিংবা কাজগুলো এখন থেমে গেছে তা কিন্তু নয়।যদি সত্য কথা বলি বা সত্যকে প্রকাশ করতেই হয় তখন আমি হয়ে যাই চরম হতাশাবাদী একজন মানুষ। তাই বলছি, দিনে দিনে আমাদের সভ্য হওয়ার পথটা মনে মনে হয় অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমরা সভ্যতার উল্টো দিকে হাঁটছি মনে হচ্ছি।এই উল্টো হাঁটাকে আমি করোনার চাইতে বড়ো সমস্যা মনে করছি।কারন রোগের ভাইরাস এক সময় হেরে যাবেই কিন্তু অন্ধকারের মহামারি থামবে কি না আমি সে ব্যপারে নিশ্চিত হবার মতো দুঃসাহসিক স্বপ্ন দেখতে ভুলেই বসে আছি।
তবু চাই আমরা সকল মহামারির কাছেই যেন হার না মানা প্রজাতির মানুষ হয়েই বেঁচে থাকি।
– শামা আরজু
লেখক, শিক্ষক