সোজা কথা ডেস্ক রিপোর্ট : শুধু নামের মিল থাকায় বিনাদোষে ৯ মাস ধরে কারাগারে আটক আছেন ভোলার লালমোহনের এক দিনমজুর। মো. লিটন নামের ওই যুবক বর্তমানে ঢাকার কেরানীগঞ্জে জেলহাজতে রয়েছেন। তার বাড়ি লালমোহন উপজেলার ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের চতলা গ্রামে। খবর যুগান্তরের
রোজকার মতো গত বছরের ৭ ডিসেম্বর মেঘনাপাড়ে ব্লকের কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিলেন লিটন, এমন সময় মঙ্গল সিকদার পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের এসআই জসিম উদ্দিন সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যান। কেন গ্রেফতার করা হয়েছে, তা না জানলেও লিটনকে পরবর্তীতে আদালতে সোপর্দ করা হয়। পরে ভোলা থেকে তাকে কেরানীগঞ্জ জেলহাজতে পাঠানো হয়।
লিটনের ভাই সাইফুল ইসলামের দাবি, তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। তিনি নিরপরাধ। দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালান। ভাইকে মুক্ত করতে ঢাকায় আদালত আর আইনজীবীর পেছনে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন সাইফুল। রিকশা চালিয়ে দিনযাপন করা সাইফুলের নিজের আর্থিক অবস্থাও ভালো না। যে কারণে উকিলের খরচ চালাতেও অসমর্থ তিনি। তিনি আক্ষুপ করে বলেন- বিনাদোষে জেল খাটতে হচ্ছে তার নিরপরাধ ভাই লিটনকে। তিনি জানান, মো. লিটন নামে চতলা গ্রামের আরেক যুবক আছেন। যিনি শৈশব থেকে ঢাকায় থাকেন। যার বাবার নামও মৃত নুরুল ইসলাম। চতলা হাইস্কুলের পেছনে ওই লিটনের বাড়ি। রাজধানীর বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তিনি। সেই লিটন আসামি হলেও কেবল নামের মিলের দরুণ তার সাজা ভোগ করছেন সাইফুলের ভাই লিটন।
ঘটনা অনুসন্ধানে জানা যায়, পল্টন থানায় ২০০৯ সালের এক মামলায় দুই বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে দেখানো হয় সাইফুলের ভাই লিটনকে। দিনমজুর লিটনের বাবার নামও নুরুল ইসলাম। যিনি অনেক আগে মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৯ সালে পল্টন থানায় যখন মামলা হয় এই দিনমজুর তখন ঢাকায়ও ছিলেন না। পল্টন থানায় যে মামলা হয়েছে; সেই মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের ২৮ জুন জিডি নং ১৯৪২/০৯ মোতাবেক ডিবির সোয়াত টিমের এসআই জুলহাস উদ্দিন আকন সঙ্গীয় অফিসার ফোর্সসহ মহানগর এলাকায় অভিযান পরিচালনাকালে পল্টন থানার আহাদ পুলিশ বক্সের সামনে দুপুরে দেড়টার সময় মো. শামীম, মো. লিটন ও আরশাদ মিয়া নামে তিনজনকে গ্রেফতার করেন। তাদের কাছে ভারত ও পাকিস্তানের তৈরি আমদানি নিষিদ্ধ ৩০০ পিস অজ্ঞান করার ট্যাবলেট পাওয়া যায়। এ ঘটনায় আটক তিনজনের বিরুদ্ধে ডিবির এসআই জুলহাস উদ্দিন আকন বাদী হয়ে পল্টন থানায় মামলা করেন।
এ মামলায় গ্রেফতারকৃত লিটনের বয়স দেখানো হয় ২৬ বছর। আর সাইফুলের ভাই লিটনের বয়স জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী সেই সময় ছিল সাড়ে ১৮ বছর। মামলাটি আদালতে বিচারের আগেই গ্রেফতারকৃত তিন আসামি জামিন নিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। ২০১৪ সালের ২২ অক্টোবর পূর্ণাঙ্গ বিচারে ঢাকা মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল নং ২-এর বিচারক জাকিয়া পারভিন আসামিদের ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(২) ধারায় প্রত্যেককে দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও দুই হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও দুই মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেন।
বিচারের সময় আসামিরা পলাতক ছিলেন। দুই বছর সাজাপ্রাপ্ত এ মামলার ওয়ারেন্ট তামিল হলে মো. লিটনের নামে লালমোহন থানায় ওয়ারেন্ট আসে। এতে প্রকৃত অপরাধী লিটন এলাকায় না থাকলেও পুলিশ দিনমজুর লিটনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
সরেজমিন চতলা এলাকায় গিয়ে কথা হয় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদ করিম নীরব ও সাবেক ইউপি সদস্য আবু সোফিয়ান জসিমের সঙ্গে। তারা লিটনের প্রতিবেশী। তারা বলেন, যে লিটন এখন জেল খাটছেন, তিনি দিনমজুর, এলাকাতেই থাকে। একই এলাকায় আরেক লিটন আছে, যার বাবার নামও নুরুল ইসলাম। সে ছোটবেলা থেকেই ঢাকা থাকে। এলাকায় আসে না। ‘ঢাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে লালমোহনের ঠিকানা ব্যবহার করে। সেই লিটনের বদলে পুলিশ দিনমজুর লিটনকে গ্রেফতার করেছে। যিনি আজ ৯ মাস ধরে বিনাদোষে জেল খাটছেন। লিটনের স্ত্রী ও দুই সন্তান আছে। যারা অসহায়ভাবে দিনযাপন করছেন।’
ঢাকার লিটনের আত্মীয়দের সঙ্গে কথা হলে তারাও এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তার চাচা ফারুক চতলা এলাকায় অটোরিকশা চালান। তিনি জানান, তার ভাই নুরুল ইসলাম প্রায় ৩০ বছর আগে মারা গেছেন। লিটন নামে তার এক ভাতিজা আছে, যে ঢাকায় থাকে। বহু বছর আগে ঢাকায় তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এর পর আর যোগাযোগ নেই।ফারুকের ছেলে জুয়েল চতলা বাজারে কম্পিউটারের দোকানে কাজ করেন। তিনি বলেন, লিটন তার চাচাতো ভাই। ঢাকায় থাকে। তার সঙ্গে পরিবারের কারও যোগাযোগ নেই।
সাইফুলের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সঞ্জয় কুমার দে (দুর্জয়) জানান, বর্তমানে মামলাটি হাইকোর্টে গেছে। আমি হাইকোর্টের আরেকজন অ্যাডভোকেটের কাছে মামলাটি প্রেরণ করেছি। এর মধ্যে লকডাউনের কারণে চার মাস কোর্ট বন্ধ হয়ে যায়, যার কারণে কোর্টে মামলা উঠেনি।