এই সত্যত্তোর যুগে বেশ কিছুকাল খোদাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বুঝতে পারছি না; উনি নিজেই গুম হলেন; বা যারা গুম করে তাদের মাধ্যমে গুম হলেন! উনি ফিরে আসতে পারবেন তো। গুম থেকে ফিরে এলেও খোদা কী আর আগের মতো থাকবেন! নানা প্রশ্ন উঁকি দেয় মনে।
আমার এক বন্ধু তানভির এ খোদা একবার গুম হয়েছিলো। তাকে কয়েকমাস আটকে রেখেছিলো এলিট ফোর্সের লোকেরা; দিনরাত তাকে জিজ্ঞেস করতো; তুই কী ভারতের দালাল নাকি পাকিস্তানের দালাল; তুই কী আওয়ামী লীগ নাকি বিএনপি? নাকি আরো দূরে হাত; মোসাদের লোক তুই! তুই কী গোপালীর ভক্ত নাকি গোলাপীর ভক্ত?
তানভীর মুচকি হেসে বলেছিলো, আমি তোমাদের লোক।
এলিটফোর্সের লোকেরা উভকামী হয়। পুরুষ গুম হলে তার স্পর্শকাতর জায়গায় ইলেকট্রিক শক দিয়ে তখন এলিটফোর্সের ফিমেল হরমোনে তোলপাড় ওঠে; আর নারী গুম হলে, এলিট ফোর্স অনেক কষ্টে শরীরের মেল হরমোন জড়ো করে তার শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দেয় জাতীয় সংগীত গাইতে গাইতে। তাতে যদি সামান্য উত্থানের সম্ভাবনা তৈরি হয়।
এরকম নজিরবিহীন নির্যাতনের গুমঘর থেকে ফিরে এসে আমার বন্ধু তানভির এ খোদা অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলো। সে ঘুমাতে পারতো না; চোখের সামনে এলিট ফোর্সের সারমেয় মুখমণ্ডল ভেসে উঠতো সারাক্ষণ। তানভির এ খোদা আর কখনো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারেনি।
অথচ উন্নয়নের ঢোল শুনে প্রতিদিন ঘুম ভেঙ্গেছে তার। এই উন্নয়নাভূতি’তে আঘাত দেবার দায়ে; সরকার সমর্থকেরা যারা উন্নয়নের দ্রুতগামী গাড়ি পথ দিয়ে যাবার সময় এর সোনায় ধূলোয় কুঁড়েঘরের জায়গায় পাকা দালান তুলেছিলো; পান্তা ভুলে পাস্তা খেয়েছিলো পাপিয়ার খলবলি ও খলবলির আসরে; সেই উন্নয়নের সমর্থকেরা এলিটফোর্সের স্যারকে ফোন করে বলেছিলো; স্যার, দেশদ্রোহী পাইছি; তুইলা নিয়া গিয়া অশেষ নেকি হাসিল করুক। তারপর একটা সাদা মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যায় তানভির এ খোদা। সে ‘উন্নয়নের সরকার বারবার দরকার’ সুরা পাঠ করতে করতে পৌঁছে গিয়েছিলো গুমঘরে। সেইখানে তার মস্তিষ্ক প্রক্ষালন করা হয়।
তাই তো ফিরে আসার পর সে দরুদ শরীফের মতো করে গায়, উন্নয়ন আমার জানের জান; আপনি আমার প্রাণের প্রাণ; আমার খোদা; পারলে বিকল্প দেখান।
তানভির এ খোদা এখন দেয়ালে ছবি টাঙ্গিয়ে সেখানে প্রতিদিন আগরবাতি জ্বেলে দেয়; পূজার ফুল দেয়, শ্রদ্ধাভজন গায়, রঘুপতি রাবণ রাজারাম; উন্নয়ন রাম, উন্নয়ন ব্যারাম, উন্নয়ন রাম।
তানভির এ খোদা এখন ফেসবুকে উন্নয়নের নাতসি যোদ্ধা। দেশের শত্রু চিহ্নিত করে। সরকারের সমালোচনা দেখলে কামড় দেয়; এই সরকার পছন্দ না হইলে দেশ ছাইড়া চইলা যান বলে।
তানভির গুজরাটের শান্তিদূতের আগমনে রাজপথে বিক্ষোভ দেখে প্যান্টের ওপর জেন্টল পার্ক আন্ডারওয়ার পরে গেরুয়া মৈত্রীর সুপারম্যান হয়ে বিক্ষোভকারীদের পেটায়। আর জয়শ্রী রাম জয়শ্রীরাম জপ করতে থাকে।
ওদিকে ধর্মের হেফাজতকারীরা যাদের নেতা অসুস্থ হলে গুজরাটে ডাক্তার দেখাতে যায়; তারাই গো-মাতার জন্য খড়বিচালি ও তৃণমূল সংগ্রহের নিমিত্তে বিক্ষোভের ওয়াজ-নাট্য মঞ্চস্থ করতে থাকে। “তালিবান-চাড্ডিবান ভাই ভাই; রক্ত আরো রক্ত চাই” শ্লোগানে শ্লোগানে পাখির মতো গুলি করে মারা হয় শিশু-কিশোর-তরুণ অনাথদের। এই লাশগুলো রাজত্বের টেকসই পূজার বলি যুগে যুগে। এবারো তাই হলো। তানভির এ খোদা সেই রক্ত এনে ঘরে তার উন্নয়নের ঈশ্বরের ছবির পদমূলে এঁকে দিলো নাতসি চিহ্ন।
কিন্তু এই ঘটনার পর থেকেই খোদাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা’কে আসামি করে পুলিশ গ্রামের পর গ্রাম পুরুষ শূণ্য করে; ঠিক সেই যুদ্ধের বছরের মতো। ধর্মের হেফাজতকারীরা তাণ্ডব চালালেও; রাধাগোবিন্দ পত্রিকা’র সাংবাদিক খঞ্জনি রায় লিখে দিলো, পাক-পন্থীদের তাণ্ডব। এরপর ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলে এক প্রতিপক্ষদলের হিন্দু তরুণী নেত্রী নিপুনকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেলো যুদ্ধের বছরের মতো। শাল্লায় আল্লার ভীতি তৈরির পর থেকেই খোদা গুম হয়ে গেলো। সংখ্যালঘুর ভয়ার্ত আর্তনাদ ছুটে আসার পর থেকেই খোদা গুম হয়ে গেলো। হিন্দু ছেলে আপন গ্রেফতার হলো যুদ্ধের বছরের মতো। সেখানেও শত শত অজ্ঞাতনামা অপরাধীদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে, গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে উঠলো। দখলদার এলিটফোর্স যেন নিপুণ শৈলীতে বিনির্মাণ করলো যুদ্ধের বছর। দখলদারদের সেনাপতি ঘোষণা দিলো, বিতর্ক এড়িয়ে যেতে আমরা আমাদের গদির হেফাজত ভাইদের নামে মামলা দিইনি; এরা তো আবার মদিরও ভাই।
এরপর থেকে সত্যত্তোর যুগের পাগলা হাওয়ায় খোদা গুম হয়ে গেলো।
স্বয়ং খোদাকে এলিটফোর্স জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে ঢুকিয়ে রেখেছে। খোদাকে তারা জিজ্ঞেস করে, তুই কী একাত্তরের পরাজিত শক্তি; তুই কী বিএনপি-জামাত, তুই কী পাকিস্তান, তুই কী আলাউদ্দীন খাঁ-র সুরের জাদুঘর ভেঙ্গেছিস! নাকি এম আই সিক্স-সি আই এ-মোসাদ ঠিক কইরা ক কইলাম; নাইলে ভালা হইবো না।
খোদা এলিটফোর্সের মানবসম্পদ বলয় খপ করে চেপে ধরে বলে, ঐ তুই না ইউনিভার্সিটির পিলু ছিলি; প্রিলিমিনারিধারায় মাস্টার্স করে এতো টারশিয়ারি জ্ঞান কই থিকা পাইলি? জানিস দাউদ (আঃ)-এর সুরের শক্তির কথা; সে সুন্দরের শক্তি কোত্থেকে এলোরে উন্নয়নের ঘরের ফইন্নি!
এলিটফোর্সের লোকটি লক্ষ্য করে তার মানবসম্পদ বলয় উধাও হয়ে গেছে। এবার তার বিশ্বাস হয়, লোকটা যে তার নাম বলেছিলো ‘খোদা’ হয়তো ঠিকই বলেছে।
এলিটফোর্সের লোকটা কেঁদে ফেলে, ও খোদা আমাকে মাফ করে দেন। আমার একান্ত সম্পদ ফেরত দেন অনুগ্রহ করে।
খোদা উত্তর দেন, তোর উন্নয়নের ঈশ্বরকে বল; তোর বলয় বানিয়ে দিতে।
এর মধ্যে এক মন্ত্রী এসে ঢুকে বলে, এই যে আপনি নাকি বলছেন এখানে বাক স্বাধীনতা নাই। আপনি কী জানেন উন্নত দেশের চেয়ে এখানে বাক স্বাধীনতা বেশি।
খোদা কিছু বলার আগেই এলিটফোর্সের লোকটা সাবধান করে মন্ত্রীকে। মন্ত্রী বলে, আমার মানবসম্পদবলয় তো আনুগত্য ভল্টে জমা রেখেছি আজ দুই দশক; ও নিয়ে ভেবোনা বলয়হীন।
খোদা মন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন, তুই তো জন্মেছিলি ফইন্নির ঘরে; কাম-কাজ তো জীবনে কিছুই করিসনি; এখন আমাকে বল, গত দশবছরে তোর এতোসম্পদ কোত্থেকে এলো!
মন্ত্রী উত্তর দেয়, আমি কাম কাজ করিনা মানে! বিশ বছর ধইরা তেল বেচতেছি; গত দশবছরে পেট্রোল-ডিজেলের রাজদণ্ড উপহার পেয়েছি; আগের দশবছর তেল বেচার অভিজ্ঞতার কারণে। আপনিও তো বান্দাদের পুরস্কার দেন; আমাদের উন্ননেশ্বর তেমনি পুরস্কার দেন।
মন্ত্রী এলিট ফোর্সকে নির্দেশ দেয় খোদাকে ফাঁকা রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে আসতে। পথে এলিটফোর্সের বলয় হারানো লোকটির অনুরোধে অগত্যা দুটো বলয় ফেরত দিয়ে খোদা নেমে যান মাইক্রোবাস থেকে।
আমাকে বারান্দায় বসে থেকে খোদা জিজ্ঞেস করেন, কী খবর? বারান্দা থেকে নামবে নাকি ওখানে বসেই কাটাবে হে নবাবজাদা!
আমার কষ্ট হয়। শৈশবে আব্বা এই গালি দিতেন; এখন খোদাও দিচ্ছেন। তাই তীব্র অনিচ্ছায় একটু গতর নড়িয়ে খোদার জন্য এক কাপ চা বানিয়ে এনে তাকে দিলে; তিনি বলেন, জানো না আমি কোন কিছু খাইনা। আমার মাঝে কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মাতসর্য কিছু নেই। ষড়রিপু মুক্ত জিতেন্দ্রিয়।
“খোদা আপনি যদি কিছু মনে না করেন; একটা প্রশ্ন করি”?
করো করো; প্রশ্ন করাকে আমি খুবই পছন্দ করি; অন্ধভক্ত অপছন্দ আমার। একশোটা গাধা অন্ধভক্ত থাকার চেয়ে একজন প্রশ্নকারী বন্ধু ভালো।
–খোদার প্রেরিত পুরুষেরা সবাই পুরুষ; নারীকে প্রেরণ করেননি কেন স্যার?
খোদা একটু অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েন। আমি মুচকি হেসে বলি, উত্তর নেই এইতো!
খোদা বলেন, নারীই তো জগতের প্রাণ; সে তো স্ব আলোকিত; তার গর্ভ আলো করে বেড়ে ওঠে সভ্যতা। তাকে আলাদা করে প্রজ্ঞা দিয়ে পাঠানোর দরকার নেই; সে হচ্ছে ধরিত্রী। কেন নারীদের দেখে এটা বোঝোনি আজো! এই যে বারান্দায় বসে গুণগুণ করো “এ খাঁচা ভাঙ্গবো আমি কেমন করে”; আর তোমার স্ত্রী দেখো কখনো এটাকে খাঁচাই ভাবে না। তোমার জন্য প্রেরিত পুরুষের শিক্ষা দরকার আছে; কিন্তু তোমার স্ত্রী’র জন্য নেই। ওর তো নিজের বোধ বুদ্ধি আছে। তোমার মতো নির্বোধ নয় হে নবাবজাদা। এখন কী চাও বলো? যা চাইবে তাই দেবো!
–আমি তো উন্নয়নের ভিক্ষুক নই খোদা; আমি চাইবো না কিছু!
খোদা বলেন, এই যে সমুদ্রের কাছে শোঁ শোঁ হাওয়ার খেয়াল শুনতে চাও; বৃক্ষের কাছে হাওয়া-ফুল-ফল চাও; পাখির কাছে গান শুনতে চাও; তেমনি আমার কাছে কিছু চাও!
–কী চাইবো খোদা; তুমি তো থাকো আমার আনন্দ-বেদনার বন্ধু হয়ে; তুমি থাকো হাসিতে-কান্নায়; প্রশ্বাসে; প্রতিটি মুহূর্তে অস্তিত্বের গভীরে। শেষবার যখন মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো, উনি একটা চিঠি দিয়েছিলেন পকেটে; পরে খুলে দেখি লেখা, সারাজীবন নিজের খেয়াল খুশির হাউই উড়িয়ে দূরে দূরে উড়ে উড়ে বেড়ালে; তাই বলে কখনো নিজে একা ভেবোনা; ঐ দূর দিগন্ত রেখায় মিশে আছে তোমার আশ্রয়; খুঁজলেই পাবে।
– মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষক
প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া