– জাহেদ উর রহমান
মেডিক্যাল প্রফেশনে নেই, কিন্তু আমি একজন ডাক্তার, এটা আমার গর্বের জায়গা। তেমনি গর্বের এই দেশের শ্রেষ্ঠ মেডিক্যাল বিদ্যাপীঠ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের একজন ছাত্র ছিলাম আমি।
ডা. মঈনকে আমি চিনতাম না, যদিও তিনি আমার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সিনিয়র ছিলেন। তাকে নিয়ে কিছু কথা বলার ক্ষেত্রে আমার ডাক্তার এবং ডিএমসিয়ান সত্ত্বাকে সরিয়ে রেখেই বলছি। তাকে নিয়ে যা ঘটল সেটা একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার শিরদাঁড়ায় বিভৎস আতঙ্কের এক হিমশীতল স্রোত তৈরি করেছে।
আমি কোনোভাবেই এটা বলছি না, করোনার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে ফ্রন্টলাইনার ডাক্তাররা আক্রান্ত হবেন না, বা মারা যাবেন না। তারা আক্রান্ত হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন আসলে সারা পৃথিবীতেই। কোনভাবেই চাই না একটা মানুষও করোনায় মারা যাক, কিন্তু যাবেই, এটাই বাস্তবতা।
যখন সিলেটে ডা. মঈন এর করোনা ডায়াগনোসিস হয়, তখন সিলেটে এই রোগী তেমন ছিল না, তাই আইসিইউর সমস্যা থাকার কথা নয়। কিন্তু আমরা দেখলাম উল্টোটা।
সিলেট মেডিক্যাল কলেজে, যেখানে উনি কর্মরত ছিলেন সেখানকার আইসিইউতে তাকে নিতে অপারগতা জানানো হয়, কারণ সেই আইসিইউতে যেহেতু অন্য রোগী ছিল সেহেতু অন্য রোগীদের মধ্যেও করোনা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকতে পারে। তারপর জানা যায়, আরেকটা হাসপাতাল শামসুদ্দিন হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য ব্যবস্থা আছে। আমরা জানলাম, সেখানে আইসিইউ আছে, কিন্তু সেটা পরিচালনার লোকবল নেই।
একজন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা তিনি, মেডিকেল কলেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, কিন্তু তাকে ঢাকায় আনার জন্য হেলিকপ্টার চেয়েও পাওয়া যায়নি। এটা তার হক ছিল, কারণ তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন স্রেফ সরকারি ব্যর্থতায় – পিপিই ছাড়া রোগী দেখে। আমাদের মনে থাকার কথা, কিছুদিন আগে একজন এসিল্যান্ডকে ঢাকায় চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে করে আনা হয়েছিল। এই সরকার ক্ষমতায় থাকতে প্রশাসন লাগে, পুলিশ লাগে, ডাক্তার লাগে না।
শুধু তাই না, তাকে ঢাকায় আনতে এম্বুলেন্সও পাওয়া যাচ্ছিল না ঠিকমত। সবশেষে অনেক দেরি করে তিনি পৌঁছতে পারেন কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে, তাও এম্বুলেন্স ব্যবস্থা করা হয় পারিবারিক উদ্যোগে। ঢাকায় পৌঁছার পথে তিনি দেখিয়ে দিলেন দেশের একটা বিভাগীয় শহরে করোনার তথাকথিত প্রস্তুতি আসলে কী।
হতেই পারত তিনি ঠিক সময়ে সিলেটে সেবা পেলে কিংবা ঢাকা চলে আসতে পারলে তিনি বেঁচে যেতেন। হতেই পারতো শুরু থেকেই ডাক্তারদের জন্য পর্যাপ্ত পিপিই থাকলে তিনি করোনায় আক্রান্তই হতেন না। তার মৃত্যু ভয়ংকরভাবে প্রমাণ করল এই দেশের তথাকথিত উন্নয়ন কী ফালতু, কী ঠুনকো!
উন্নয়ন মারানো সরকারি লোকরা আপাতত গর্তে ঢুকেছে। জানি, করোনা পরিস্থিতি আরেকটু শান্ত হলেই ওরা গর্ত থেকে বের হবে এবং শুরু করবে উন্নয়ন মারানো। আমরা একেবারেই মেরুদন্ডহীন, নপুংসক হয়ে গেছি, তাই আমাদের সামনে ওসব কথা আবারও বলা যাবে।
সরকার ঘোষণা করেছে, করোনা আক্রান্ত হলে ডাক্তাররা ১০ লক্ষ টাকা পাবেন, আর মারা গেলে সেটা হয়ে যাবে পাঁচ গুণ অর্থাৎ ৫০ লক্ষ টাকা। সেই বিবেচনায় ডা. মঈন এর পরিবার ৫০ লক্ষ টাকার ভাগীদার হয়েছেন। উন্নয়ন মারানিরা নিশ্চয়ই এখন ৫০ লাখ টাকা দেয়া দেখিয়ে বলবে আমরা উন্নয়নের রোল মডেল বলেই পারছি ৫০ লক্ষ টাকা দিতে। তবুও চলবে উন্নয়ন মারানো।
-জাহেদ উর রহমান এর ফেইসবুক পোস্ট ১৫.০৪.২০২০
তিনি সংযুক্ত ফ্যাকাল্টি মেম্বার, ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ