শিপুফরাজী, বাংলাদেশ থেকে
জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব কত না ভাবে পড়ছে। এর সঙ্গে সমান্তরালে পাল্লা দিয়ে উপকূলীয় এলাকায় বাড়ছে দুর্যোগের ঝুঁকি। আর উপকূলের যেকোনো দুর্যোগেই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে শিশুরা। দুর্যোগ মৌসুমে উপকূলবাসী নানান ঝুঁকি নিয়ে তটস্থ থাকলেও তাদের সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা থাকে পরিবারের শিশুদের নিয়ে।
ছবির শিশুটির নাম রাশেদ। বয়স আনুমানিক ১০ বছর। তার বাড়ি ভোলার চরফ্যাসন উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ঢালচরে। এ বয়সী শিশুরা যতটা চঞ্চল হয় রাশেদ ঠিক তার উল্টো। কেমন যেন একটা আনমনাভাব মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে সে। আর তা ফুটে উঠে তার চেহারায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশেষ করে নদী ভাঙনের কারনে শিশুরা পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেনা। রাক্ষুসে মেঘনার ভাঙন উলট পালট করে দিয়েছে রাশেদের সব ।
সম্প্রতি ঢালচর গিয়ে দেখা হয় রাশেদের সাথে , সে আমাদেরকে জানিয়েছে তার জীবনের গল্প। বিগত ২ বছর আগে ‘আমাগো বাড়ি ছিল ঐখানে। এখন কিছু নাই।’ স্বাভাবিক জীবন ছিল তার। চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের কেরামতগন্জ গ্রামে ছিল অন্য সবার মতই একটি পরিবার। তারা ছিল মা-বাবা, দুই ভাই আর এক বোন। কিন্তু জলবাযু পরিবর্তনে রাক্ষুসে মেঘনার ভাঙনের কারণে উলট পালট হয়ে গেছে তার সব। ভাঙনের কারনে যখন উপকূলীয় গ্রামাঞ্চলের পরিবারগুলো তাদের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়, তখন শিশুরা কার্যকরভাবে তাদের শৈশব হারায়। নদীভাঙনে সর্বস্ব হারিয়ে ঠাই হয় শহরের বস্তিতে। ঢালচরের রাশেদের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি । কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই রাশেদের বাবা-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। রাশেদের মা সেতারা বেগম (৩৫) ঢাকার কোনো এক বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করছে। শহরে বিপদ ও বঞ্চনার সম্মুখীন হওয়ার পাশাপাশি শোষণ ও নিগ্রহের শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বাইরে কাজে যেতে চাপের মুখে পড়ে রাশেদের ৮ বছরের ছোট ভাই রিয়াদ শিশু শ্রমিক হিসেবে কাজ করে । রাশেদ এখন দাদির কাছে থাকে ঢালচরে । রাশেদ সবেমাত্র দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠছিল। নদী ভাঙনের কারণে ঢালচরে জেলে পাড়ার কোমল মতি শিশুদের মত সেও বিদ্যালয় ছেড়েছে । এখানে জেলে পাড়ার শিশুদের স্কুলে যাওয়াটা জীবনের আরেক যুদ্ধ। আর সেই যুদ্ধে পরাজিত অনেকেই এখন মাছধরাসহ বহুমূখী শ্রমে রোজগারে ব্যস্ত; রাশেদের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করে মানুষ হবে। কিন্তু বিরূপ প্রকৃতি সহায় হয়নি। অবশেষে স্কুলের বইখাতা ফেলে শ্রমিকের তালিকায় নাম লেখাতে বাধ্য হয়েছে। শুধু রাশেদই নয় তার মতই আরো শত শত শিশু আছে যারা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে স্কুলবিমুখ হয়ে হারিয়েছে তাদের সুন্দর শৈশব। তারা হয়তো আর কোনদিন ফিরে পাবে না শিক্ষার সুযোগ। এ চিন্তা করার ফুসরতও তাদের নেই। ভাঙনের কালে জীবন যখন বড় হয়ে দাঁড়ায়, তখন শিক্ষাতো সোনার হরিণই বটে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এভাবে অজস্র রাশেদ ঝরে পড়ছে। রাশেদদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।